সময়ের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে ভাবতেন রবীন্দ্রনাথ। তাই তাঁর লেখা উপন্যাস বা ছোটগল্প আজও সমান প্রাসঙ্গিক। দশকের পর দশক ধরে রবীন্দ্রনাথের লেখনি প্রাণ পেয়েছে রূপোলি পর্দায়।শতাব্দী বদলেছে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ফিরে ফিরে এসেছে সিনেমায়। সাদাকালো যুগ থেকে ২০২০-ছবিটা একই রয়েছে।
নতুন শতাব্দীতে রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাসকে রূপোলি পর্দায় যাঁরা তুলে ধরেছেন তাঁদের মধ্যে ঋতুপর্ণ ঘোষ অন্যতম। চোখের বালি ও নৌকাডুবি রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি অবলম্বনে দুটি ছবি নির্মান করেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ।
ঋতুপর্ণ ঘোষের সমসাময়িক পরিচালকদের মধ্যেই বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের চলচ্চিত্রভাবনাকেও নাড়া দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘এলার চার অধ্যায়’-এর মূল ভাবনা ঘিরে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ রচিত চার অধ্যায় উপন্যাস। ব্রিটিশ ভারতের প্রেক্ষাপট,দেশের প্রতি কর্তব্য আর প্রেম এই দুইয়ের মাঝখানের দ্বন্দ্বে জর্জরিত এলা। ছবিতে এলার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন পাওলি দাম।
এক্কেবারে সাম্প্রতিককালে যেসব পরিচালকদের চলচ্চিত্র দর্শনে রবি ঠাকুরের ভাবনা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর মধ্যে অন্যতম অমিতাভ ভট্টাচার্য। তাঁর দ্বিতীয় ছবি ‘রক্তকরবী’ মুক্তি পায় ২০১৭ সালে। রবীন্দ্রনাথের সাংকেতিক নাটক রক্তকরবীকে আজকের প্রেক্ষাপটে তৈরি করেছিলেন অমিতাভ। মানুষের ওপর মানু্যের শোষণ, ব্যক্তির অবমাননা, অব্যক্ত প্রেম, বিদ্রোহ, রাষ্ট্রের প্রতি জোর গলায় প্রতিবাদ-সবই আছে এই নাটকে।
হিন্দুস্তান টাইমস বাংলাকে তিনি জানালেন-‘ বাঙালির যে কোন ভাবনার সঙ্গেই জড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ। রক্তকরবী রবীন্দ্রনাথের একটি রাজনৈতিক নাটক। আজকের প্রেক্ষাপটে আমি সেটা তৈরির চেষ্টা করেছি। মানুষ যদি কোনও সিস্টেম তৈরি করে সেই সিস্টেম তাকেও গ্রাস করে ফেলতে পারে-জীবনের এই চরম সত্যিটা রবীন্দ্রনাথ এখানে তুলে ধরেছেন। এটা শুধু রাজনীতি নয়-দেশে কালের গন্ডি পার করেও এটা সত্যি। ১৯২৬ সালে রক্তকরবী লেখা হয়েছিল। আজ ২০২০-তে দাঁড়িয়ে প্রায় একশো বছর পরেই এই সত্যিটা বদলায়নি একবিন্দু। আগামী ১০০ বছরেও পাল্টাবে না’। তিনি যোগ করেন ‘আমার কাছে রবীন্দ্রনাথের এক একটা কথার এক একটা অর্থ আমি বিভিন্ন বয়সে অনুভব করেছি। হয়ত দশ বছর পর আমি আরও অন্যভাবে রক্তকরবী বানাতে পারবো’।
রবি ঠাকুরের লেখা সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস চতুরঙ্গ নিয়ে ২০০৮ সালে সুমন মুখোপাধ্যায় তৈরি করেছিলেন একই নামের চলচ্চিত্র। তবে পরিচালকের ক্যামেরার লেন্সে একবারই রবীন্দ্র লেখনি মূর্ত হয়েছে তা নয়। ২০১৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল সমুন মুখোপাধ্যায়ের শেষের কবিতা। অমিত, লাবণ্য, কেতকীর প্রেম-সম্পর্কের জটিলতা সবই ধরা দিয়েছে এই ছবিতে।
বর্তমান প্রজন্মের পরিচালকদের মধ্যে রবীন্দ্র সৃষ্টির সবচেয়ে বিতর্কিত অ্যাডপশন নিঃসন্দেহে কিউয়ের তাসের দেশ।রবীন্দ্রনাথের নাটককে সমকালীন ছাঁচে ফেলেছেন কিউ।এটা মূলত কিউয়ের চোখে তাসের দেশের ভাবানুবাদ। তাই তিনি পত্রলেখা ও হরতনির মধ্যে যৌনমুক্তির চেতনা ও সমকামিতা খুঁজে পেয়েছেন। সমালোচনা হলেও অনেক চলচ্চিত্র বোদ্ধারাই কিউকে ভালো নম্বরে পাস করিয়েছিলেন। যদিও পরিচালকের কথায় তিনি নাকি রবীন্দ্রনাথ দ্বারা আকৃষ্ট নন, কিন্তু তাসের দেশ তাঁর ঘাড়ে চেপেছিল ১২ বছর ধরে। ২০১৩ সালে মুক্তি পেয়েছিল এই ছবি।
রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস বা নাটক নিয়েই আজকের প্রজন্মের পরিচালকরা চলচ্চিত্র নির্মান করেছেন তেমনটা নয়-রবীন্দ্রনাথের কবিতাও বাদ যায়নি। রেশমি মিত্র রবি ঠাকুরের হঠাত্ দেখা কবিতাকে চিত্ররূপ দিয়েছেন। ছবিতে অভিনয় করেছেন দেবশ্রী রায়,ইলিয়াস কাঞ্চনরা। ২০১৭ সালে মুক্তি পেয়েছিল এই ছবি।
শুধু বাংলা ছবির পর্দাতেই আটকে থাকেনি রবীন্দ্রনাথের ভাবনা। এপিক চ্যানেলের জন্য বাঙালি পরিচালক অনুরাগ বসু তৈরি করেন ‘স্টোরিস বাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’। এই বহুল প্রশংসিত শোয়ে চোখের বালি, চারুলতা, কাবুলিওয়ালা,ডিটেক্টিভ, সমাপ্তির মতো রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প নিয়ে তৈরি হয়েছিল এই সিরিজ।
এছাড়াও কবিগুরুর কাবুলিওয়ালা উপন্যাস অবলম্বনেও ২০১৮ সালে পরিচালক দেব মেধাকর তৈরি করেন বায়াস্কোপওয়ালা।