প্রাচ্যের বেশির ভাগ দেশেই মাটিতে বসে খাবার খাওয়ার চল এখনও রয়েছে। এখনও অনেক বাঙালি বাড়িতেই এভাবে খাবার খাওয়া হয়। যদিও নগরজীবনে ডাইনিং টেবিলে খাবার খাওয়া চল বেড়ে গিয়েছে, কিন্তু একেবারে হারিয়ে যায়নি মাটিতে বসে খাবার খাওয়া। দক্ষিণ ভারত, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং পাঞ্জাবের মতো ভারতের অনেক জায়গায় এখনও খাবার খাওয়া হয় মাটিতে বসে। পশ্চিমবঙ্গের অনেক জায়গায় এখনও পংক্তিভোজন করান হয়।
চিকিৎসকরা বলছেন, সেই অভ্যাস খুবই কাজের। কারণ এটি আমাদের স্বাস্থ্যের উপর অনেক ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং আমরা অনেক রোগ থেকেও রক্ষা পাই। আসলে মাটিতে, বাবু হয়ে বসে খাওয়ার সময় আমাদের শরীরের ভিতরে বেশ কিছু পরিবর্তন হতে শুরু করে।
জেনে নেওয়া যাক, মাটিতে বসে খাবার খাওয়ার উপকারিতা:
হার্টের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়: হাঁটু মুড়ে বসে থাকাকালীন শরীরের উপরের অংশে রক্তের প্রবাহ বেড়ে যায়। ফলে হার্টের কর্মক্ষমতা বাড়তে শুরু করে। সেই সঙ্গে হ্রাস পায় যে কোনও ধরনের হার্টের রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও।
সারা শরীরে রক্ত চলাচলের উন্নতি ঘটে: আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে প্রতিটি অঙ্গে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত পৌঁছে যাওয়াটা জরুরি। এটি যত বাড়বে, তত রোগের প্রকোপ কমবে। সেই সঙ্গে সার্বিকভাবে শরীরও চাঙ্গা হয়ে উঠবে। আর যেমনটা আগেও আলোচনা করা হয়েছে যে, বাবু হয়ে বসে থাকাকালীন সারা শরীরে বিশুদ্ধ অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্তের চলাচল বেড়ে যায়।
স্ট্রেসের মাত্রা কমে: শুনতে আজব লাগলেও একাধিক জায়গায় দেখা গিয়েছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাটিতে বসে থাকলে শরীর এবং মস্তিষ্কের অন্দরে বেশ কিছু পরিবর্তন হতে শুরু করে, যার প্রভাবে স্ট্রেস হরমোনের ক্ষরণ কমে যায়। ফলে মানসিক অবসাদ তো কমেই, সেই সঙ্গে স্ট্রেসের মাত্রাও কমতে শুরু করে।
মাটি বসে খেলে একাধিক আসন করা হয়ে যায়: মাটিতে বসে খাওয়ার সময় আমরা নিজেদের অজান্তেই একাধিক আসন, যেমন- সুখাসন, স্বস্তিকাসন অথবা সিদ্ধাসন করে ফেলি। ফলে মাটিতে বসে খাওয়ার সময় পেট তো ভরেই সেই সঙ্গে শরীর ও মস্তিষ্ক, উভয়ই ভিতর থেকে চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
শরীর শক্তপোক্ত হয়: মাটিতে বসে খাওয়ার অভ্যাস করলে উরু, গোড়ালি এবং হাঁটুর কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে শিরদাঁড়া, পেশি, কাঁধ এবং বুকের ফ্লেক্সিবিলিটিও বাড়ে। ফলে সার্বিকভাবে শরীরে সচলচা যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি নানাবিধ রোগও দূরে থাকে।
হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটে: বাবু হয়ে বসে খেলে হজম ক্ষমতার উন্নতি হয়। তাই যাঁদের বদহজমের সমস্যা রয়েছে, বা যাঁরা প্রায়শই গ্যাস-অম্বলে ভোগেন, তাঁদের ভুলেও টেবিল-চেয়ারে বসে খাওয়া উচিত নয়। পরিবর্তে মাটিতে বসে পাত পেরে খাওয়া উচিত। আসলে বাবু হয়ে বসে খাওয়ার সময় আমরা কখনও আগে ঝুঁকে পরি, তো কখনও সোজা হয়ে বসি। এমনটা বারে বারে করাতে হজম সহায়ক ‘ডায়জেস্টিভ জ্যুস’-এর ক্ষরণ বেড়ে যায়। ফলে হজম প্রক্রিয়া খুব সুন্দরভাবে হতে থাকে।
আয়ু বৃদ্ধি পায়: মাটিতে বসে খেলে শরীরের সচলতা বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে শরীরের অন্দরে কোনও ধরনের ক্ষয়-ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাও হ্রাস পায়। প্রসঙ্গত, ২০১২ সালে ইউরোপিয়ান জার্নাল অব প্রিভেন্টিভ কার্ডিওলজিতে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, যাঁরা কোনও সাপোর্ট ছাড়া মাটিতে বসে থাকতে থাকতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পরতে পারেন, তাদের শরীরে ফ্লেক্সিবিলিটি বেড়ে যাওয়ার পাশপাশি একাধিক অঙ্গের কর্মক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটে, ফলে স্বাভাবিক ভাবেই আয়ু বৃদ্ধি পায়। আর যাঁরা এমনটা করতে পারেন না, তাঁদের আয়ু অনেকাংশেই হ্রাস পায়। প্রসঙ্গত, এই গবেষণাটি ৫১-৮০ বছর বয়সিদের মধ্যে করা হয়েছিল।
ব্যথা কমে: বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মাটিতে বসে খাওয়ার সময় আমরা মূলত পদ্মাসনে বসে থাকি। এইভাবে বসার কারণে পিঠের, পেলভিসের এবং তল পেটের পেশির কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। সেই সঙ্গে সারা শরীরের কর্মক্ষমতা এত মাত্রায় বৃদ্ধি পায় যে, সব ধরনের যন্ত্রণা কমে যেতে সময় লাগে না।
ওজন কমে: মাটিতে বসে খাওয়ার সময় আমাদের ভেগাস নার্ভের কর্মক্ষমতা বেড়ে যায়। ফলে পেট ভরে গেলে খুব সহজেই ব্রেনের কাছে সে খবর পৌঁছে যায়। ফলে অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার ইচ্ছা চলে যায়। এমনটা যত হতে থাকে, তত ওজন বৃদ্ধির আশঙ্কাও কমে। প্রসঙ্গত, আমাদের পেট ভরেছে কি না সেই খবর মস্তিষ্কের কাছে পৌঁছোলেই আমাদের খাওয়ার ইচ্ছা চলে যায়। আর এই খবর মস্তিষ্ককে পাঠায় ভেগাস নার্ভ।
এবার বুঝতে পারছেন তো, মাটিতে বসে খাওয়া-দাওয়া করাটা কতটা জরুরি।