রণবীর ভট্টাচার্য
শুক্রবার ছিল লেনিনের জন্মদিন। এই বছর বড় অদ্ভুত সময়ে লেনিনের জন্মতারিখ এসে পড়েছে। সেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মাঝখানে একটা শতক, আর লেনিনের জায়গায় পুতিন। দুটো যুদ্ধের মধ্যে ফারাক কতখানি? তাহলে ফিরে যেতে হয় গত শতাব্দীতে, যখন রাশিয়া দুনিয়া জুড়ে স্বপ্ন দেখাচ্ছে বামপন্থার। বলশেভিকদের আমলে নতুন সূর্যোদয়ের ইঙ্গিত ছিল, সমানাধিকার ছিল নতুন অঙ্গীকার এবং সাম্যের বাণী ছিল জাতীয় সঙ্গীত। কিন্তু যে রকম হওয়ার ছিল সে রকম হল না। ১৯২৪ সালে লেনিন চলে গেলেন। তারপর ইতিহাস এগিয়ে গেল। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে ধীরে ধীরে বামপন্থা তার রাস্তা হারাল আর ধণতন্ত্র আর দক্ষিণপন্থীদের দাপটে আজ রুদ্ধসঙ্গীতের খোঁজে রয়েছে বামপন্থীরা।
ভারতে আদর্শ সব সময়েই প্রাসঙ্গিক, কারণ ভারত শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়, দিয়ে এসেছে এবং দেবে। কিন্তু রাজনৈতিক আদর্শের দিক থেকে আজ লেনিনের বামপন্থা ভোটের কাঠগড়ায় প্রশ্নের মুখে। বামপন্থী দলগুলো ক্ষমতার কথা বললে শেষমেশ কেরালায় এসে দাঁড়িয়েছে। মিছিলে ভিড় হয়, ফেসবুক পোস্টে লাইক হয় কিন্তু ভোট পড়ে না কেন?
এই প্রশ্ন পশ্চিমবঙ্গ থেকে ত্রিপুরা, বামপন্থী দলগুলোর নেতানেত্রী থেকে সাধারণ সদস্যদের। কোথাও কি তাহলে দল আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছে? অথবা আদর্শের গোলপোস্ট কি সরানোর সময় এসেছে? কেন লেনিনের ছবিগুলি লোকাল কমিটির অফিসে কিংবা বন্ধ ক্লাবঘরে নিতান্ত অনাদরে পড়ে রয়েছে?
বাস্তবের মাটিতে কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্লাসে লেনিন, স্টালিন বা মাও-এর কর্ম প্রণালীর সহজ ব্যাখ্যা সহজ নয়। হাততালি ও হোঁচট খেয়ে পড়ার সম্ভাবনা যথেষ্টই। তাই কথায় কথায় অনেক ঘরোয়া বামপন্থী নিজেকে লেনিনিস্ট আখ্যা দিলেও, বাস্তব বহুদূরে। মস্কোতে বা বেজিংয়ে বা নিদেনপক্ষে ভিয়েতনামে যেই স্ট্র্যাটেজি কাজ করেছে, সেটি গোবরডাঙায় বা রানিগঞ্জ এলাকায় কাজ করবে এটা ভাবাই ভুল। লেনিনের মৃত্যুর পর ঘটে গেছে অনেক কিছু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম দেখেছে সারা পৃথিবী, পরমাণু বোমার হঠকারী ব্যবহার ও অগুনতি মানুষের মৃত্যু দেখেছে সবাই, ভারতের মতো অনেক দেশ স্বাধীন হয়েছে, ঠান্ডা যুদ্ধে মেতে উঠেছে আমেরিকা-রাশিয়া। তারপর বদলেছে অস্থির মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্থান কব্জা করেছে তালিবানিরা, সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে টুকরো হয়েছে, ক্ষমতার পরিবর্তন সহজেই চোখে পড়েছে বিভিন্ন দেশে। সোভিয়েত রাশিয়া থেকে পুতিনের রাশিয়া হয়ে ওঠার লড়াইটা কিন্তু কম চমকপ্রদ নয়। কিন্তু পুতিনের রাশিয়া কি অদূর ভবিষ্যতে আরও টুকরো টুকরো হয়ে যাবে? বর্তমান রাশিয়া নামেই গণতন্ত্র হলেও ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছে কিছু মানুষ যারা শাসকের কাছাকাছি।
মস্কোর রেড স্কোয়ারে নিঝুম নিঃশব্দে চিরঘুমে শায়িত লেনিন কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইঙ্গিত পেয়েছেন? এর উত্তর সামনের দিনেই পাওয়া যাবে কমরেড!