স্বাধীনতার ৭৬টা বছর কেটে গেছে। কেবল কি স্বাধীনতার? দেশভাগেরও তো এতগুলি বছর অতিবাহিত হল। আজ থেকে ছিয়াত্তর-সাতাত্তর বছর আগের সময়কালে ভারতবর্ষ জুড়ে স্বাধীনতা আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন যেমন দানা বেঁধেছিল, তেমনই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের মনোভাবও একাংশের মানুষের মধ্যে জন্মাতে শুরু করে। এই পরিস্থিতিতেই ১৬ অগস্ট থেকে ২০ অগস্ট পর্যন্ত চলে 'দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং'।
উভয় ধর্মের প্রায় চার হাজার মানুষ নিহত হন এবং দশ হাজার মানুষ আহত হন। এই বিভীষিকাময় সময়েও কেউ কেউ জীবনের বিনিময়ে পথে নেমেছিলেন সাম্প্রদায়িক অশান্তি প্রতিহত করতে। তাঁদের কথা এই সময়ে আরও একবার স্মরণ করা যেতেই পারে। মহম্মদ ইসমাইল তেমনই এক নাম। অকুতোভয় ট্রাম শ্রমিকরা কালকাতায় উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে উড়িয়েছিলেন শান্তির পায়রা। কেবলই কি ইসমাইল! শত-শত ট্রাম শ্রমিক সেই সময় কলকাতার রাজপথে সাম্প্রদায়িক অশান্তি প্রতিহত করতে শান্তির বার্তা নিয়ে পথে নেমে ছিলেন। এই ব্যতিক্রমী ইতিহাস স্মৃতির পাতায় আজ ফিকে, কিন্তু অস্বীকার করা যায় না।
কোনও গল্প কথার রাজপুত্র নয়, বিরাট মাপের নেতা-মন্ত্রীও নয়। হিন্দু-মুসলমান বিভাজন রেখা মেরামতের ‘অসম্ভব’ চেষ্টা করেছিলেন কলকাতার সাধারণ ট্রাম শ্রমিকেরা। তৎকালীন সময়ের নথিপত্রে রয়েছে তার স্পষ্ট বিবরণ। একটি প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ‘রাজাবাজার এলাকায় ইসমাইলের নেতৃত্বে শ্রমিকরা দাঙ্গা প্রতিরোধে সচেষ্ট হন। ইসমাইল ও স্থানীয় শ্রমিক কর্মীদের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও তাদের কর্ডন ভেঙে উত্তেজিত জনতা সাড়ে ১১টার সময় মানিকতলার দিকে যায়। আমাদের কর্মীরা তাদের বিরত করার জন্য পিছনে পিছনে দৌড়ায়। ইসমাইল মহল্লার বয়স্কদের শান্তি রক্ষার জন্য অনুরোধ করেন। তখন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে আমাদের স্থানীয় কর্মীরাই এই উত্তেজনার হাত থেকে ট্রাম কর্মীদের ও গ্যাসকর্মীদের মুক্ত করেন।’
মহম্মদ ইসমাইলের নেতৃত্বেই সে দিন মধ্য কলকাতার দিনমজুর, কলাবাগান বস্তির মহিলাবাহিনী হাতা-খুন্তি আর লাঠি, বেলচা নিয়েই আটকেছিলেন সম্প্রদায়িক অশান্তি পাকাতে আসা উন্মত্ত বাহিনীকে। এক ঘণ্টার লড়াই লাঠিসোঁটা, ইট-পাটকেল নিয়েই প্রতিহত করেন তাঁরা।
ভিক্টোরিয়া কলেজের মেয়েদের উগ্র ধর্মীয় বাহিনী আক্রমণ করতে গেলেও রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ট্রাম শ্রমিকেরা। টানা তিন দিন তিনরাত ছাত্রীদের আগলে রাখার পর নিরাপদে তাঁদের বাড়ি ফেরার বন্দোবস্ত করেন তাঁরা। কিন্তু কীসের জোরে এত সব অসাধ্য সাধন সম্ভব হয়েছিল? এমন প্রশ্ন উত্তরে এক ট্রাম শ্রমিক জানান, ‘উও সুরখী ঝান্ডা দেখ রাহে হ্যায় সাহাব, উও সুরখী ঝান্ডা জব একবার উড়তা হ্যায় না তব উসকো উতারনা নামুনকিন হ্যায়।’ অর্থাৎ হিন্দু মুসলিম বিভাজনকে হারিয়ে সেদিন জিতেছিল দিন মজুর ট্রাম কর্মীদের ঐক্যবন্ধ লড়াই, সম্প্রীতির চেতনা। এর নাম বোধহয় ভারত, আমাদের দেশ।