ইহুদি বনাম আরবীয়। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে যে ঝামেলার সূত্রপাত হয়েছিল, সেটার ফল হিসেবে কার্যত যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইনে। শনিবার সকালে গাজা ভূখণ্ড থেকে রকেট হানার পর ভূমি, জল ও আকাশপথে ইজরায়েলে আক্রমণ চালিয়েছে ‘জঙ্গি সংগঠন’ হামাস। মৃত্যু হয়েছে কয়েকশো মানুষের। পালটা জবাব দিয়েছে ইজরায়েলও। সেইসবের মধ্যে লেবানন থেকেও রকেট ছোড়া হয়েছে বলে দাবি করেছে তেল-আভিভ। কিন্তু ঠিক কী নয়ে ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইনের মধ্যে ঝামেলা চলছে, তাতে হামাস জড়িয়ে গেল কীভাবে? জেনে নিন সেই সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য।
ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সমস্যার সূত্রপাত
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্য পরাজিত হওয়ার পরে প্যালেস্তাইনের দখল নিয়েছিল ব্রিটেন। যেখানে ইহুদিরা সংখ্যালঘু ছিলেন। আর সংখ্যাগুরু ছিলেন আরবের মানুষ। প্যালেস্তাইনকে ইহুদিদের দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ব্রিটেনেকে দায়িত্ব দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মহল। তার জেরে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে টানাপোড়েন বাড়তে শুরু করেছিল।
১৯২০-র দশক থেকে ১৯৪০-র দশকে প্যালেস্তাইনে লাফিয়ে-লাফিয়ে ইহুদি অভিবাসীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছিল। যাঁরা মূলত গণহত্যার জেরে ইউরোপ ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলেন প্যালেস্তাইনে। সেই পরিস্থিতিতে দুই গোষ্ঠীর (ইহুদি ও আরবীয়) মধ্যে সংঘাত আরও বাড়তে শুরু করেছিল। ঘোরালো হয়ে উঠতে শুরু করেছিল সমস্যা। সেইসঙ্গে ইহুদিদের জন্য পৃথক দেশ গড়ে তোলার দাবিও ক্রমশ জোরালো হতে শুরু করেছিল।
সেই পথ ধরেই রাষ্ট্রসংঘ এবং ব্রিটেনের সাহায্যে জন্ম হয় ইজরায়েলের। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের যে পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল রাষ্ট্রসংঘে, তাতে ঠিক হয়েছিল যে ব্রিটিশদের হাতে থাকা প্যালেস্তাইনকে দুটি ভাগে ভাগ করা হবে। একটি দেশ হবে ইহুদিদের জন্য। অপর দেশটি আরবীয়দের জন্য হবে বলে ঠিক করা হয়েছিল। তবে সেই পরিকল্পনা ঘিরে ঐক্যমত তৈরি হয়নি। বরং প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই যুদ্ধ শুরু বেঁধে গিয়েছিল। যে যুদ্ধে সামিল হয়েছিল প্রতিবেশী একাধিক আরব দেশ।
১৯৪৯ সালে প্রথম আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। সেই যুদ্ধে জিতেছিল ইজরায়েল। কিন্তু লাখ-লাখ প্যালেস্তাইনি নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন বা তাঁদের উৎখাত করা হয়েছিল। একাধিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ঘরছাড়া হয়েছিলেন ৭.৫ লাখ প্যালেস্তাইনি। যে ঘটনাকে 'আল নকবা' বা বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। সেইসঙ্গে ওই অঞ্চলকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল - ইহুদিদের ইজরায়েল, আরবের ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং গাজা স্ট্রিপ।
কিন্তু তাতে কোনও সমাধানসূত্র বের হয়নি। ফেরেনি শান্তিও। বরং পরবর্তীতে একাধিক যুদ্ধ হয়েছে। কখনও বড় সংঘাত হয়েছে। কখনও হয়েছে ছোটখাটো সংঘাত। আর তাতে হাজার-হাজার মানুষের প্রাণ গিয়েছে। সেইসবের মধ্যেই ক্রমশ নিজেদের শক্তি বাড়িয়েছে ইজরায়েল। মূলত পশ্চিমী দুনিয়ার সাহায্যে নিজেদের শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
তৃতীয় 'ইন্তিফাদা'-র সূচনা?
অনেকের মতে, এবার হামাস যে হামলা চালিয়েছে, তাতে তৃতীয় 'ইন্তিফাদা'-র সূচনা হল। 'ইন্তিফাদা' হল একটি আরবিক শব্দ। অর্থ হল যে নাড়িয়ে দেওয়া। যে শব্দ ১৯৮৭ সাল থেকে ব্যাপক আকারে ব্যবহৃত হতে থাকে। একটি মহলের বক্তব্য, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং গাজায় ইজরায়েলের উপস্থিতির বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ গড়ে তোলা হয়, তা ব্যাখ্যা করতেই 'ইন্তিফাদা' শব্দ ব্যবহার করেন প্যালেস্তাইনিরা।
প্রথম 'ইন্তিফাদা' শুরু হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। চলেছিল ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত। দ্বিতীয় 'ইন্তিফাদা'-র সূচনা হয়েছিল ২০০০ সাল। চলেছিল ২০০৫ সাল পর্যন্ত। দ্বিতীয় 'ইন্তিফাদা' সমাপ্ত হওয়ার পরেও ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনের সংঘাত কমেনি। একাধিক মহলের দাবি, প্যালেস্তাইনি ভূখণ্ডে নিজেদের উপস্থিতি ক্রমশ বাড়াতে থাকে ইজরায়েল। আবার হামাস, প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) মতো প্যালেস্তাইনি সংগঠন 'সন্ত্রাসমূলক কাজকর্ম' বাড়াতে থাকে।
হামাস কী এবং কীভাবে উৎপত্তি হল হামাসের?
১৯৮৭ সালে প্রথম 'ইন্তিফাদা'-র সূচনার পর হারাকাত আল-মুকাওয়ামা আল-ইসলামিয়া (হামাস) তৈরি করেছিলেন প্যালেস্তাইনি ধর্মগুরু শেখ আহমেদ ইয়াসিন। যা প্যালেস্তাইনের বৃহত্তম বিচ্ছিন্নতাবাদী ইসলামিক গোষ্ঠী এবং ওই অঞ্চলের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল। বর্তমানে গাজা স্ট্রিপের ২০ লাখের বেশি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে হামাস। যে সংগঠনকে জঙ্গিগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করেছে ইজরায়েল, আমেরিকা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও অন্যান্য একাধিক দেশ।
আশির দশকের শেষলগ্নে তৈরি হলেও নব্বইয়ের দশকে স্বাক্ষরিত অসলো শান্তিচুক্তির (ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের মধ্যে হয়েছিল) বিরোধিতা করে মূলত উত্থান হয়েছিল হামাসের। বেড়েছিল গুরুত্ব। একাধিক রিপোর্ট অনুযায়ী, হামাসের বক্তব্য ছিল, শান্তিচুক্তিতে যে দ্বিরাষ্ট্র তত্ত্বের কথা বলা হয়েছে, তাতে প্যালেস্তাইনের মানুষদের অধিকার খর্ব হবে।
সেই শান্তিচুক্তি যাতে বাতিল করে দেওয়া হয়, সেজন্য একাধিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল হামাস। তার জেরে মৃত্যু হয়েছিল ইজরায়েলের অসংখ্য মানুষের। ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে গোষ্ঠীর এক বড় ‘নেতার’ মৃত্যুর পর হামলার মাত্রা বাড়িয়েছিল হামাস। যে 'নেতা' বোমা বানানোর নেতৃত্বে ছিলেন। সেই লাগাতার বিস্ফোরণের জেরে শান্তিচুক্তি থেকে ইজরায়েল সরে গিয়েছিল বলে একাধিক মহলের দাবি। অপর একটি মহলের বক্তব্য, ইজরায়েলের ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলিও সেই শান্তিচুক্তির বিরোধী ছিল।
তারইমধ্যে হামাসের দাপট ক্রমশ বাড়তে থাকে। বৃদ্ধি পেতে থাকে রাজনৈতিক গুরুত্বও। একটি অংশ (ইজরায়েলের মতো দেশ) যেমন হামাসকে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তেমনই আবার হামাসকে মসিহা হিসেবে দেখে অপর একটি অংশ। প্যালেস্তাইনের ‘ক্ষতি’-র প্রতিশোধ নিতে হামাস যেভাবে হামলা চালায়, সেটা ওই অংশ সমর্থন করে। আবার ওই অংশের দাবি, গাজা স্ট্রিপে গরিব এবং অসহায়দের সাহায্য করে হামাস।
ইজরায়েল এবং হামাসের সংঘাত- প্রাণহানি
হামাস যত শক্তিশালী হয়েছে, তত ইজরায়েলের সঙ্গে সংঘাত বেড়েছে। দু'পক্ষের সবথেকে ভয়াবহ সংঘাত হয়েছিল ২০১৪ সালে। ৫০ দিনের যুদ্ধে প্রায় ১,৫০০ সাধারণ নাগরিক-সহ ২,৩০০ জন প্যালেস্তাইনির মৃত্যু হয়েছিল। ইজরায়েলে ৬৭ জন জওয়ান এবং ছয়জন সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছিল। ২০২১ সালের মে'তে জেরুসালেমর আল-আকসা চত্বরে ইজরায়েলের বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ঘে কয়েকশো প্যালেস্তাইনি আহত হয়েছিলেন। আল-আকসা থেকে ইজরায়েলের বাহিনী প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে গাজা থেকে ইজরায়েলের পরপর রকেট হামলা চালিয়েছিল গাজা। ১১ দিনের যুদ্ধে প্রায় ৩০০ জন মারা গিয়েছিলেন।