প্রায় এক বছর ২ মাস পর প্রকাশ্যে এল কোঝিকোড়ে এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস বিমান দুর্ঘটনার চূড়ান্ত রিপোর্ট। তাতে চালক ও বিমানসংস্থার একাধিক ত্রুটির কথা জানিয়েছেন তদন্তকারীরা। এমনকী এয়ার ইন্ডিয়ার পরিচালন ব্যবস্থাই প্রশ্নের মুখে পড়েছে এই তদন্তে রিপোর্টে। ২০২০ সালের ৭ অগাস্ট সন্ধ্যায় কোঝিকোড় বিমানবন্দরের রানওয়ে পেরিয়ে পাহাড় থেকে আছড়ে পড়ে এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের বোয়িং ৭৪৭ বিমানটি। দুবাই থেকে ওড়া ওই বিমানে ১৮৬ আরোহী ছিলেন। তার মধ্যে ২ চালকসহ মৃত্যু হয় ২১ জনের। আহত হন বহু।
তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, বিমানের ক্যাপ্টেন দীপক শাঠি এয়ার ইন্ডিয়ার প্রশিক্ষক পাইলট ছিলেন। কোঝিকোড় বিমানবন্দরে অবতরণের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। বিমান চালানোয় ১০ হাজার ঘণ্টার বেশি অভিজ্ঞতা ছিল ক্যাপ্টেনের। তার পরও এমন দুর্ঘটনার তদন্তে নেমে একাধিক চাঞ্চল্যকর তথ্য খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা।
জানা গিয়েছে, বিমানটি নিয়ে দীপক শাঠি যখন কোঝিকোড় থেকে দুবাইয়ের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন তখন তিনি জানতেন পরদিন তাঁর ছুটি। কিন্তু দুবাইয়ে অবতরণের পর তিনি জানতে পারেন তাঁকে পরদিনও বিমান ওড়াতে হবে। প্রত্যেক পাইলটের ২টি শিফটের মধ্যে নির্দিষ্ট ব্যবধান রাখা বাধ্যতামূলক। তাই পরের দিন একটি উড়ানের সময় পিছিয়ে দেয় এয়ার ইন্ডিয়া কর্তৃপক্ষ। ওদিকে দুবাই বিমানবন্দর থেকে ফেরার সময় বিমান ওড়ানোর ছাড়পত্র পেতে কিছু দেরি হয় ক্যাপ্টেনের। যাতে তাঁর উদ্বেগ আরও বাড়ে।
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ক্যাপ্টেন শাঠির কিছুদিন আগেই টাইপ ২ ডায়াবেটিস ধরা পড়েছিল। ফলে চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ খাচ্ছিলেন তিনি। বাণিজ্যিক বিমান ওড়ানোর নিয়ম অনুসারে নির্দিষ্ট বেশ কিছু এমন ওষুধ আছে যা খেলে বিমান ওড়ানোর অনুমতি মেলে না। খাতায় কলমে তেমন কোনও ওষুধ না খেলেও নিজে থেকে ক্যাপ্টেন এমন ওষুধ খাচ্ছিলেন যার ফলে রক্তে দ্রুত শর্করার মাত্রা হ্রাস পেতে পারে। যার ফলে ঝিমুনি আসে ও সংকটের সময় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানের বিমান সেবিকারা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার আগে বিমানে তেমন কিছু খাননি পাইলট। তাই তদন্তকারীদের ধারণা, রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যাওয়ায় সিদ্ধান্ত নিতে অনেক দেরি করে ফেলেছিলেন পাইলট। যার ফলে রানওয়ের নির্দিষ্ট এলাকা পেরিয়ে যাওয়ার পর বিমানটি অবতরণ করেন তিনি।
এই তদন্তে এয়ার ইন্ডিয়ার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ গাফিলতি ও ত্রুটির কথা উঠে এসেছে। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, সেদিন ক্যাপ্টেন দীপক শাঠির সহকারী পাইলট অখিলেশ কুমার পাইলট হিসাবে ছিলেন নিছকই নবীন। মেরে কেটে ২০০০ ঘণ্টা বিমান ওড়ানোর অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। ফলে গুরুত্বপূর্ণ সময় ক্যাপ্টেন ভুল করছেন জেনেও তাঁকে বাধা দিতে পারেননি তিনি। শেষ মুহূর্তে তিনি অবতরণের পরিকল্পনা বাতিল করতে নির্দেশ দিলেও তাতে কান দেননি ক্যাপ্টেন। বিমানে এরকম অসমান অভিজ্ঞতার ক্যাপ্টেন ও কোপাইলটকে মোতায়েন করা বিমানের নিরাপত্তার শর্ত বিরুদ্ধ।
এছাড়া এয়ার ইন্ডিয়ার পাইলটরা একটি নির্দিষ্ট বিমানবন্দর ভিত্তিক হলেও ক্যাপ্টেনদের ক্ষেত্রে তেমন কোনও শর্ত নেই। যে কোনও শহরের ক্যাপ্টেন যে কোনও বিমানবন্দর থেকে বিমানের দায়িত্ব নিতে পারেন। যার ফলে বহু ক্ষেত্রে ক্যাপ্টেনদের সঙ্গে কোপাইলটদের কোনও পরিচয়ই থাকে না। যা ককপিট পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেন।
এমনকী এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান প্রশিক্ষণেও বড়সড় গাফিলতির কথা উল্লেখ করেছেন তদন্তকারীরা। যে নকল বিমানে এয়ার ইন্ডিয়ার পাইলটদের বোয়িং ৭৩৭ ওড়ানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় সেটিতে একাধিক ত্রুটি রয়েছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
তদন্তে উঠে এসেছে, দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানটির ক্যাপ্টেনের দিকে উইন্ডশিল্ডের ওয়াইপার কাজ করছিল না। তার পরও বৃষ্টির মধ্যে বিমান অবতরণের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এমনকী পরের দিন তাঁকে বিমান ওড়াতে হবে এই চাপে বিমান নির্দিষ্ট পথ ধরে রানওয়ের দিকে এগোচ্ছে না জেনেও অবতরণ করতে মরিয়া ছিলেন তিনি। যার ফলে ঘটে এই দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনার তদন্তের পর মোট ৩৮টি সুপারিশ করেছেন তদন্তকারীরা। তদন্ত রিপোর্টে দেখা গিয়েছে ১০ বছর আগে ম্যাঙ্গালুরু বিমান দুর্ঘটনার থেকে কিছুই শেখেনি এয়ার ইন্ডিয়া।