৭২ ঘণ্টা পার হলে ধর্ষণ মামলা না নেওয়ার পরমর্শ দিয়ে বিচারক সীমা লঙ্ঘন করেছেন৷ আর এর ফলে ধর্ষকরা উৎসাহিত হবে বলে মনে করেন আইনজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা৷ সংশ্লিষ্ট বিচারক ভিক্টিমের চরিত্র হনন করেছেন বলেও মনে করেন তাঁরা৷
বহুল আলোচিত রেইন্ট্রি হোটেল ধর্ষণ মামলার রায়ে পাঁচ আসমীকেই খালাস দিয়েছেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোছাম্মাত কামরুন্নাহার৷বৃহস্পতিবার ঘোষিত রায়ের পর্যক্ষেণে তিনি বলেন, ‘৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না৷ পুলিশ যেন ৭২ ঘণ্টা পর কোনও ধর্ষণের মামলা না নেয়৷' তিনি আরও মন্তব্য করেন, ‘ভিক্টিম যৌনকর্মে অভ্যস্ত৷ মেডিকেল রিপোর্ট ও ডিএনএ টেস্টে ধর্ষণের প্রমাণ মেলেনি৷' পাঁচজন আসামীর চারজনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেও তাঁদের মারপিট করে জবানবন্দি নেওয়ার কথা বলেন তিনি৷ তিনি তদন্তের ত্রুটির কথাও বলেন৷ এজন্য তদন্ত কর্মকর্তাকে ভর্ৎসনাও করেন৷
কিন্তু পুলিশ যেন ৭২ ঘণ্টা পর কোনও ধর্ষণের মামলা না নেয় এবং ভিক্টিম যৌনকর্মে অভ্যস্ত- তার এই কথা ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে৷ বৃহস্পতিবার মধ্যরাতেই নারীরা শাহবাগ থেকে সংসদ ভবন পর্যন্ত ‘শেকল ভাঙার পদযাত্রা' করে বিচারকের পর্যবেক্ষণের প্রতিবাদ জানান৷ তারা সাক্ষ্য আইনের ‘ধর্ষণ বান্ধব' ধারা বাতিলের দাবি তোলেন৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সমালোচনার ঝড় বইছে৷
নারী নেত্রী এবং বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রধান অ্যাডভোকেট সালমা আলি বলেন, ‘বিচারকের ওই মন্তব্য ধর্ষকদের উৎসাহিত করতে পারে৷ ধর্ষকরা এখন ধর্ষণের পর ভিক্টিমকে ৭২ ঘণ্টার বেশি আটকে রাখতে পারে রেহাই পাওয়ার জন্য৷ আর থানাগুলো ধর্ষণের মামলা নিতে আরও অনীহা প্রকাশ করতে পারে৷' তাঁর কথা, ‘শুধু মেডিকেল রিপোর্টই ধর্ষণ মামলার বিচারের একমাত্র সাক্ষ্য প্রমাণ নয়৷ উচ্চ আদfলতের স্পষ্ট নির্দেশনা আছে, শুধুমাত্র ভিক্টিমের সাক্ষ্যের ভিত্তিতেও বিচার করা যাবে৷ পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য এবং আলামতের ভিত্তিতেও বিচার করা যাবে৷ কারণ, একজন নারী বাংলাদেশের যে প্রেক্ষাপট তাতে সামাজিক কারণে অনেক সময়ই ঘটনা লুকিয়ে রাখতে চায়৷ আবার ট্রমার মধ্য দিয়ে যাওয়ার কারণে আলামত সংরক্ষণের বিষয়টি তখন ভাবতেও পারে না৷ ঘৃণার কারণে পরিস্কার হয়ে যায়৷ গোসল করে ফেলে৷' অ্যাডভোকেট সালমা আলি জানান, তিনি অনেক ধর্ষণ মামলাই ভিক্টিমের পক্ষে পরিচালনা করেছেন, যা ধর্ষণের ছয় মাস থেকে এক বছর পর দায়ের করা হয়েছে৷
আইন বিশ্লেষকরা বলছেন, রেইন্ট্রি হোটেল ধর্ষণ মামলায় বিচারকের পর্যবেক্ষণ সংবিধান ও আইনের বিরুদ্ধে গিয়েছে৷ কারণ, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করার কোনও সময় বেঁধে দেওয়া নেই৷ আর সংবিধানে জীবন, সম্পত্তি রক্ষার অধিকার ও বিচার পাওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে৷ বিচারক তাঁর মন্তব্যের মাধ্যমে বিচার পাওয়ার অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করতে চাইছেন৷
সংবিধান বিশ্লেষক, আইনের অধ্যাপক এবং মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘ওই বিচারক তাঁর মন্তব্যে সীমা লঙ্ঘন করেছেন৷ তিনি সংবিধান ও আইনের সীমা লঙ্ঘন করেছেন৷ বিচারিক আদালতের কাজ সুনির্দিষ্ট বিষয়ের বিচার করা৷ জ্ঞান দেওয়া তাদের কাজ নয়৷ এটা উচ্চ আদালতের কাজ৷ তিনি তাঁর সীমার বাইরে গিয়ে মন্তব্য করেছেন৷'
তিনি মনে করেন, এতে অপরাধীরা উৎসাহিত হবে৷ তাছাড়া তাঁর মতে, বিচারক যে নারীর চরিত্র হনন করেছেন৷ তা মেনে নেওয়া যায় না৷ তিনি বলেন, ‘আমাদের সমাজে নারীকে অসম্মান করার যে মানসিকতা আছে, বিচারক তাঁর মন্তব্যে সেটাই করেছেন৷ একজন বিচারক যদি এটা করেন তবে তা ভয়াবহ৷' তাঁর মতে, ‘একজন যৌনকর্মীও ধর্ষণের শিকার হতে পারেন, এটা বুঝতে হবে৷' সালমা আলি বলেন, ‘একটি মেয়েকে তার বয়ফ্রেন্ডও ধর্ষণ করতে পারে৷ ধর্ষণ বিষয়টি বুঝতে হবে৷ আমাদের দেশে নারীরাও যে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের হতে পারে- এই বিচারক তার প্রমাণ দিলেন৷'
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, ‘বিচারক আসামীদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি কীভাবে গ্রহণ করবেন, সেটা তাঁর ব্যাপার৷ কিন্তু সেটা নিয়ে উপেক্ষামূলক মন্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়৷ কারণ, হাইকোর্ট স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, কেউ যদি আদালতে দেওয়া জবানবন্দি পরে প্রত্যাহার করার আবেদনও করেন, তাতে জবানবন্দি অগ্রহণযোগ্য হয় না৷' তাঁর মতে, ‘বিচারিক আদালত দেশের সব মামলা নিয়ে মন্তব্য করতে পারেন না৷ আর তিনি যে মন্তব্য করেছেন তাতে নেতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা আছে৷' সালমা আলি মনে করেন, ‘এই মামলায় ক্ষমতাবানদের দাপট স্পষ্ট৷ মামলা দায়ের থেকে শুরু করে তদন্ত ও বিচার সবখানেই৷ তদন্তেও অনেক ত্রুটি আছে৷'
এর কী প্রতিক্রয়া হবে এবং কতটা বেআইনি এবং অসাংবিধানিক তা দেখার জন্য অপেক্ষা করার পরামর্শ দেন প্রাক্তন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ৷ তিনি বলেন, ‘আইন ও সংবিধানের বাইরে গিয়ে মনগড়া কোনও মতামত দিলেই তো হবে না৷ নিশ্চয়ই এটা নিয়ে আপিল হবে৷ উচ্চ আদালতে যাবে৷ তখন আদালত এটা দেখবেন৷'
(বিশেষ দ্রষ্টব্য : প্রতিবেদনটি ডয়চে ভেলে থেকে নেওয়া হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে সেই প্রতিবেদনই । তাতে যে বিশেষজ্ঞদের মতামত ব্যবহার করা হয়েছে, তা রাখা হয়েছে। হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার কোনও প্রতিনিধি এই প্রতিবেদন লেখেননি।)