নিজের প্রযোজিত ছবিতে গান গাইবেন লতা মঙ্গেশকর। এটা এক সময়ে যে কোনও প্রযোজকের কাছেই স্বপ্নের মতো ছিল। সেই স্বপ্ন পূরণও হয়েছে বাংলা ছবির অত্যন্ত নামজাদা প্রযোজক তপন বিশ্বাসেরও।
‘উৎসব’, ‘চোখের বালি’, ‘তিতলি’র মতো ছবির প্রযোজনা করেছেন তপনবাবু। ১৯৮৮ সালে ‘পরশমণি’ নামের একটি ছবি তৈরি করেন তিনি। ছবির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তরুণ মজুমদার। সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সেই ছবিতেই সন্ধ্যা রায়ের কণ্ঠে একটি গান গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। ‘যায় যে বেলা যায়’। কিন্তু সেই গানটি ছাড়াও তপনবাবুর অন্য অভিজ্ঞতা আছে লতা মঙ্গেশকরকে নিয়ে।
‘আমার প্রথম ছবি। নাম ‘কলঙ্কিনী’। ছবির কাজ শেষ হওয়ার অনেক আগেই মুক্তির তারিখ ঠিক করে ফেলেছিলাম। আর ঠিক করেছিলাম ছবিতে কাজ করবেন উত্তম কুমার। তার ক’দিন আগেই ‘ও গো বধূ’র কাজ করার সময়ে উত্তমবাবুর মাথায় চোট লেগেছে। উনি বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন না। কিন্তু উত্তমবাবুর স্যুটের মাপ নিতে হবে। কী করব, কিছুই বুঝছি না।’ পুরনো কথা বলেন তপনবাবু।
‘এর মধ্যে আমাদের মুম্বই (তখন বম্বে) যাওয়ার কথা। আমি, ছবির সুরকার শ্যামল মিত্র আর পরিচালক দীনেন গুপ্ত। উত্তমবাবুর সঙ্গে কথা হচ্ছে না। তাই চিন্তায় পড়ে গিয়েছি। হঠাৎ মহানায়কের ফোন! আমাকে বললেন, শুনলাম, চিন্তায় আছেন। নিশ্চিন্তে বম্বে থেকে ঘুরে আসুন। স্যুটের মাপ নিয়ে চিন্তা নেই। খোকা (দীনেন গুপ্ত)-কে বলে দিন, আমার কাছে তিনশোর বেশি স্যুট আছে। ওর পছন্দমতো পরে নেব অসুবিধা হবে না।’
এর পরে তপনবাবু, শ্যামল মিত্র এবং দীনেন গুপ্ত রওনা হয়ে যান মুম্বইয়ের উদ্দেশে। প্রথম কাজ, ছবির গানের জন্য কিশোর কুমারকে রাজি করানো।
‘কিশোর কুমারের সঙ্গে দেখা হল না। কিন্তু ওঁর সহকারী শ্যামল মিত্রকে বললেন, কোনও চিন্তা নেই, কিশোরজি আপনার সঙ্গে কাজ করেছেন। উনি আপনার গান গাইবেন। স্টুডিয়ো থেকে ফিরে এলাম। পর দিন সকালে তিন জনে একসঙ্গে বসে চা খাচ্ছি, হঠাৎ ডোর বেল বাজল। শ্যামল মিত্রর সহকারী দরজা খুলতে গেলেন। বাইরের ঘর থেকে কানে এল, কেউ একটা মারা গিয়েছেন। আর একটা শব্দও শুনতে পেলাম। ‘কুমার’! বুকের মধ্যে ছ্যাঁত করে উঠল! কিশোর কুমারের কিছু হল না তো! ওঁর জন্যই তো বম্বে আসা।’
ফোনের ওপারে খানিক থেমে আবার বলতে থাকেন তপনবাবু। ‘এর পরে দেখি শ্যামল মিত্র কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়েছেন প্রায়। আমায় বললেন, কলকাতায় ফিরে যেতে চান। উত্তম কুমার আর নেই!’
উত্তম কুমার নেই! বাংলা ছবির কী হবে? ওঁদের কী হবে? যে ছবির জন্য এত দূর আসা, সেই ‘কলঙ্কিনী’রই বা কী হবে?
তপনবাবু বলতে থাকেন, ‘বম্বে থেকে আমরা চলে আসি। তার আগে একবার দেখা হয় আশাজির সঙ্গে। আমরা আশাজির বাড়ি গিয়েছিলাম। আশাজি হঠাৎ বললেন, শ্যামলদা, লতাজি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। সেদিন দেখেছিলাম, বাংলা ছবির প্রতি, বাঙালিদের প্রতি লতাজির কী অগাধ টান আর ভালোবাসা। শ্যামল মিত্রের সঙ্গে দেখা হতেই লতাজি ওঁর হাত ধরে কাঁদতে শুরু করলেন। বললেন, উত্তমবাবু এত তাড়াতাড়ি চলে গেলেন! কী হবে এর পরে? কাকে আশ্রয় করে এগোবে বাংলা সিনেমা? সেদিন বসে বসে শুনেছিলাম, লতাজির সঙ্গে উত্তম কুমারের কাজের অভিজ্ঞতা।পুরনো গল্প। এক কিংবদন্তির মুখে থেকে শোনা আর এক কিংবদন্তির গল্প।’
এর পরে ১৯৮৮ সালে ‘পরশমণি’ ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে গান গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। ছবির প্রযোজক তপন বিশ্বাস। ‘সে বার মুম্বই থেকে কলকাতায় আসতে পারেননি লতাজি। হেমন্তবাবু বললেন, গানটা লতাজিকে দিয়েই গাওয়াতে হবে। তাই কলকাতা থেকে ট্র্যাক রেকর্ড করে পাঠিয়ে দেওয়া হল। উনি মুম্বই থেকে গলা রেকর্ড করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এখানে আবার পুরোটা জুড়ে দেওয়া হয়।’ বলছেন তপনবাবু।
কেমন ছিল কাজের সূত্রে সেই স্বল্প সময়ের অভিজ্ঞতাও?
তপনবাবুর কথায়, ওইটুকু সময়েই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, কেন অত বড় মাপের শিল্পী তিনি। ‘সময়ানুবর্তিতাই হোক, সুর-তাল-লয়ের প্রশ্নই হোক, শত অসুস্থতাতেও একচুল নড়চড় হয়নি তাঁর দেওয়া কথার। সেই কারণেই তিনি লতা মঙ্গেশকর।’