আরও একবার পারিবারিক, সামাজিক ও কিয়দাংশে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নতুন ছবি নিয়ে হাজির সুপারস্টার দেব। ছবির নাম 'প্রধান'। বহু চর্চার পর অবশেষে ২২ ডিসেম্বর মুক্তি পেয়েছে দেবের এই ছবি। গল্প বলছে এটা মূল ধারার বাণিজ্যিক ছবির ছাঁচে তৈরি 'Cop Drama'। যেখানে কিনা বলিউডের 'সিংঘম' স্টাইলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে নীতির পাঠ পড়িয়েছেন পুলিশ অফিসার 'দীপক প্রধান'।
ছবির গল্প ও বিশ্লেষণ
উত্তরবঙ্গের পাহাড় ঘেরা কাল্পনিক গ্রাম ধর্মপুর। আর সেই ধর্মপুরে যে বড় অধর্ম! চলছে পঞ্চায়েত প্রধানের কারসাজিতে নীতিহীন অরাজকতা। পঞ্চায়েত প্রধান জটিলেশ্বরই এখানে সমস্ত দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, তাঁর অঙ্গুলিহেলনেই চলে ধর্মপুর। সেই ধর্মপুরেই সদ্য বিয়ে করে বউকে নিয়ে এন্ট্রি নেবেন আরও এক প্রধান। আর ইনি হলেন থানার বড়বাবু 'দীপক প্রধান' দেব। আর এরপরই শুরু হবে ধর্মপুরের আসল খেলা।
ধর্মপুরে এসেই ‘দীপক প্রধান’ বুঝিয়ে দেন, তিনি ঘুষ নেন না, শিরদাঁড়া তাঁর সোজা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি লড়বেন, মানুষের পাশে দাঁড়ানোই তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য। বুঝিয়ে দেন 'পদে নয়, তিনি বিপদের প্রধান'। দেবের ভোকাল টনিক বদলে দেয় তাঁর জুনিয়র পুলিশ আধিকারিক ‘বিবেক’(সোহম) এর বিবেক। দেব ও বিবেক মিলে পাশে দাঁড়ান একসময় মিথ্যে চুরির দায়ে চাকরি ও সম্মান খোয়ানো গ্রামের হেডমাস্টার জীবনকৃষ্ণের। শুরু হয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই। আর সাপের ল্যাজে পা দিলে ছোবল তো খেতেই হয়। সাপ তো ফোঁস করবেই। আর সেটাই ঘটে। দীপক প্রধানকে গ্রাম থেকে সরাতে উঠে পড়ে লাগেন পঞ্চায়েত প্রধান জটিলেশ্বর। আর ঠিক তখনই শুরু হয় পঞ্চায়েত ভোট। এই ভোটকে কেন্দ্র করেই ঘটে যায় আরও অনেককিছু। জমে ওঠে খেলা।
নাহ, এরপরের গল্পটা আর বলা যাবে না, তাহলে তো হলে গিয়ে সিনেমা দেখার মজাটাই চলে যাবে। তবে হ্যাঁ, 'প্রধান'-এ বেশ জমে উঠেছিল দুই 'প্রধান'-এর লড়াই। আর সেটাই এই ছবির আসল বিনোদন। এই ছবি দুর্নীর বিরুদ্ধে একজন সৎ পুলিশ আধিকারিকের লড়াই-এর গল্প বলে। আর তাতে মিশেছে আরও অনেক রসদ। এখানে দেব-সৌমিতৃষার মিষ্টি রোম্যান্স, পারিবারিক গল্প যেমন রয়েছে, তেমনই আছে পুলিশ প্রশাসন ও রাজনীতির কথা, রয়েছে জমজমাট অ্যাকশন দৃশ্য। পাশাপাশি উঠে এসেছে, মিড ডে মিল দুর্নীতি, রাস্তা বানানোর অর্থ আত্মসাৎ, ছাপ্পা ভোট, গণনায় কারচুপি সহ আরও অনেক বাস্তব সমস্যার কথা। ছবিতে পঞ্চায়েত ভোটকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে টানটান উত্তেজনা। সেই ভোটে কে জিতবে কে হারবে তা নিয়ে চলেছে বেশকিছুক্ষণের চাপা টেনশন। ঠিক যেমনটা আমির খানের 'লগান'-এ ক্রিকেট ম্যাচকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল, খানিকটা যেন তেমনই। সবমিলিয়ে ছবির শুরু থেকে শেষ সবটাই বিনোদনমূলক, বাণিজ্যিক মশালা ছবির সব রসদই কমবেশি এখানে রয়েছে।
আরও পড়ুন-ওরা নাকি নাকউঁচু, বাংলা ছবি দেখে না! কিন্তু আমাদের দেখলেই সেলফি তুলতে আসে: সোহম
আরও পড়ুন-'ও তো বিয়ে না করেও বন্দি', দেবের মনের কথা ফাঁস করলেন সোহম
সমস্যা
ছবিতে তৈরি হওয়া বেশকিছু সমস্যাকে আরও একটু বিশদে দেখালে হয়ত গল্পের জটিলতার বুনন আর একটু শক্তপোক্ত হত। যেমন গ্রামের বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পিছনে আলাদা করে কোনও সংঘাত, ঘটনা পরবর্তী রেশ দেখানো হয়নি। গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান জটিলেশ্বরের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীদের মনেও যে ক্ষোভ রয়েছে, সেটাও আলাদা করে দেখানো হয়নি। আবার হেডামাস্টার জীবনকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর ছেলের দূরত্ব, আবার সেই ছেলেই হঠাৎ করে ভোটের সময় গ্রামে চলে আসে, এই ঘটনাগুলি মধ্যে কোনও যোগসূত্র তৈরি করা হয়নি। এমনই বেশকিছু ফাঁক রয়েছে।
পারফরম্যান্স
শেষ বেশকিছু ছবিতে অভিনেতা হিসাবে যথেষ্ঠ প্রশংসনীয় দক্ষতার ছাপ রেখেছেন দেব। এই ছবিতে পুলিশ আধিকারিকের বেশে দেবের অভিনয় প্রশংসার দাবি রাখে। তাঁর সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছেন সোহম চক্রবর্তী, সুজন মুখোপাধ্যায়। বর্ষীয়ান, কিংবদন্তি পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মমতা শঙ্করের অভিনয় নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। সেই সঙ্গে খরাজ মুখোপাধ্যায়, অম্বরীশ ভট্টাচার্য, কাঞ্চন মল্লিক, বিশ্বনাথ বসু, সোহিনী সেনগুপ্ত বুঝিয়ে দিয়েছেন যে ওঁরা জাত অভিনেতা। নিজ নিজ চরিত্রে মন্দ করেননি কনীনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবাশিস মণ্ডল, সৌমিতৃষা কুণ্ডু, তুলিকা বসু, জন ভট্টাচার্য, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী এবং অন্যান্যরা। আর এখানে ‘একেন বাবু’র খোলস ছেড়ে খলনায়কের চরিত্রে এখানে নিজের বিশেষ ছাপ তৈরি করেছেন অভিনেতা অনির্বাণ চক্রবর্তী। আর বলাই বাহুল্য, 'প্রজাপতি'-পর আরও একবার 'প্রধান'-এর হাত ধরে পরিচালক হিসাবে প্রশংসার দাবি রাখলেন অভিজিৎ সেন।
একটা কথা না বললেই নয়, অভিনেতা, প্রযোজকের পাশাপাশি, দেব নিজে একজন সাংসদ। সেক্ষেত্রে একজন সাংসদ হয়েও নিজের ছবিতে মিড ডে মিল দুর্নীতি, রাস্তা বানানোর অর্থ আত্মসাৎ, ছাপ্পা ভোট, গণনায় কারচুপির মতো সমস্যা তুলে ধরতে ধক লাগে বৈকি। তাই এক্ষেত্রে ছবির অন্যতম প্রযোজক দেবের আলাদা করে প্রশংসা না করলে অন্যায় হয়।
আর যদি ছবির কথায় আসা যায়, তাহলে চিত্রনাট্য কিছু ফাঁক থাকলেও শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত 'প্রধান' ছবিটি বেশ বিনোদনমূলক। এ ছবি দেখতে হিয়ে দর্শক কোথাও সেভাবে 'বোর' হবেন না। পরিবার, বাচ্চা সকলকে নিয়ে গিয়ে দিব্যি দেখে ফেলা যায় এই ছবি। আবার অনেক ক্ষেত্রে ছবির বেশকিছু ঘটনা আবেগতাড়িত করেছে, দর্শকদের চোখে জল এনেছে। সব মিলিয়ে বিনোদনমূলক ছবি হিসাবে দেবের 'প্রধান' মন্দ নয়। এ ছবিকে ৫-এ ৪ দেওয়াই যায়।