বিহারে এনডিএ-র ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন রাজ্যের জোট রাজনীতিতে বড়সড় পরিবর্তন ঘটাল এবং জোট সমীকরণের নেতৃত্বের রশি প্রত্যাশা অনুযায়ী বিজেপি-র করায়ত্ত হল।
২০১৪ সালের লোক সভা নির্বাচনে বিজেপি-র বিশাল জয় জোট রাজনীতির গুরুত্বে আঘাত হেনেছিল। ২০১৯ সালের নির্বাচনে দলের যুগান্তকারী জয়ের পরে সেই তত্ত্বে সিলমোহর দিয়েছিল। ফলে জোটের উপর নির্ভরতা ক্রমেই কমতে থাকে।
কেন্দ্রে পর পর দুই বার একক গরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় এলেও কিছু রাজ্যে তবু জোট সমীকরণের উপরে নির্ভরশীল থাকতে হয় পদ্ম শিবিরকে। তারই একটি বিহার। কেন্দ্রীয় সরকারের জনপ্রিয় উন্নয়ন প্রকল্প সমূহের জোর বিহারের জাতপাত ভিত্তিক রাজনীতির ময়দানে বিশেষ আঁচড় কাটতে না পারায় কার্যত বাধ্য হয়েই জেডিইউ-এর সঙ্গে হাত মেলায় বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে মেনে নেওয়া হয় নীতিশ কুমারের নাম এবং প্রার্থী মনোনয়নে জোটসঙ্গীর আব্দারও।
বিজেপি-জেডিইউ জোটে বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে শেষ মুহূর্তে জোট ত্যাগ করে লোক জনশক্তি পার্টি। তবে তাতে নির্বাচনী দৌড়ে গুরুতর কোনও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়নি এনডিএ-কে।
বিহারের উচ্চ শ্রেণির মধ্যে বিজেপি-র জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। এ বাদে নিম্ন শ্রেণির মধ্যে প্রতিপক্ষ আরজেডি-র জনপ্রিয়তায় ধস নামাতে বিশেষ করে যাদবদের প্রাধান্যের কথাও মাথায় রাখতে হয়েছে বিজেপি থিঙ্কট্যাঙ্ককে। একই সঙ্গে নিরন্তর প্রশ্রয় দিতে হয়েছে ওবিসি সম্প্রদায়ের নানান অভিযোগ ও দাবির।
বিহার রাজনীতির প্রেক্ষিতে ভোটের অঙ্ক কষতে গিয়ে নজর রাখতে হয়েছে ইবিসি শ্রেণিভুক্ত মহাদলিত ভোটারদের কথা, যা দলিত ও কুর্মিদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাজ্যের ৩০% ভোট আকর্ষণ করে। বাধ্য হয়ে তাই জোট রাজনীতিতে লো প্রোফাইল রাখতে হয়েছে কেন্দ্রের শাসকদলকে।
অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি-কে তাড়া করেছে তা হল, উপযুক্ত নেতার অভাব। এ ক্ষেত্রেও তাই ‘সুশাসনবাবু’ নীতীশকেই প্রচারের অগ্রভাগে রাখা ছাড়া উপায় ছিল না। নিজের গুরুত্ব টিকিয়ে রাখতে অবশ্য প্রচারে মোদী-নীতীশ ‘ডবল ইঞ্জিন’ তত্ত্ব খাড়া করেছে গেরুয়া ব্রিগেডে।
জোট রাজনীতিতে শামিল হওয়ার জন্য বিজেপি-র আরও একটি কারণ হল আঞ্চলিক প্রত্যাশা পূরণ। একই কারণে আসন্ন তামিল নাডু ও কেরালা বিধানসভা নির্বাচনে সেই জোট সমীকরণের উপরেই নির্ভর করতে চলেছে বিজেপি। বস্তুত নব্বইয়ের দশক থেকে জাতীয় রাজনীতির প্রাঙ্গনে গুরুত্ব বাড়তে থাকে জোট সমীকরণের। এনডিএ এবং ইউপিএ, দুই জোটেই আঞ্চলিক দলগুলির প্রভাব কালক্রমে বৃদ্ধি পেতে দেখা গিয়েছে এই সময় থেকে।
সম্প্রতি বিহার বিধানসভা নির্বাচনের সাফল্যের পরে বিজেপি-জেডিইউ সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন মত পোষণ করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের একাংশ মনে করছেন, এবার জেডিইউ-এর ছায়া থেকে বেরিয়ে একক প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা করবে বিজেপি। এর অন্যতম কারণ হল বিজেপি ও জেডিইউ শিবিরের অনেকেরই ধারণা, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরাসরি অংশগ্রহণের ফলে রাজ্য রাজনীতিতে নীতীশ কুমারের ক্যারিশমায় কিছুটা ভাটা পড়েছে। ইতিমধ্যেই মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বিজেপি প্রতিনিধি বসানো নিয়ে ফিসফাস শুরু হয়েছে দুই দলের অন্দরেই।
গুঞ্জন আমল না দিয়ে বিজেপি নেতৃত্ব অবশ্য মেপে পা ফেলার পন্থাই অবলম্বন করতে চাইছে। বিশেষ করে গুরুত্ব হরণের অভিযোগ তুলে শিব সেনা ও শিরোমণি অকালি দল এনডিএ জোট ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে সাবধানী হয়েছে বিজেপি কেন্দ্রীয় মন্ত্রক। তার আগে ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে এনডিএ ছেড়েছে টিডিপি, অসম গণপরিষদ, এমডিএমকে, আরএলএসপি, গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা ও পিডিপি।
জোট রাজনীতিতে বিজেপির প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে দলের রাজ্য সভা সাংসদ বিনয় সহস্রবুদ্ধের মত, ‘রাজনীতিতে জোটের গুরুত্ব উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর এই বিষয়ে বিজেপি বিশেষজ্ঞ বলা যায়। জোট ধরে রাখার কৌশল আমাদের করায়ত্ত।’
সব দিক বিচার করে অতএব বলা যেতেই পারে, বিহার বিধানসভা নির্বাচনে সাফল্য পাওয়ার পরেও নিজের স্বার্থেই জোট রাজনীতিতে আস্থা রাখতে চলেছে কেন্দ্রের শাসকদল।