কথায় আছে, ঠেকে শেখে মানুষ। কথাটা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ক্ষেত্রে যে কতটা প্রয়োজ্য, তা দিল্লি বিধানসভার ফল বেরোনোর পর একেবারে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন : কে জিতলেন-কে হারলেন, একনজরে হেভিওয়েট প্রার্থীদের রেজাল্ট
যে কেজরিওয়াল একটা সময় ক্রমাগত মোদী বিরোধিতায় মুখ খুলছিলেন, গোটা দিল্লি নির্বাচনের প্রচার পর্বে মোদীর বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করলেন না। কিন্তু কেন? রাজনৈতিক মহলের মতে, লোকসভা ভোটের আগে বালাকোটে অভিযান হোক না পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলা - বিভিন্ন ইস্যুতে মোদী সরকারের সমালোচনা করেছিলেন কেজরিওয়াল। তার ফল অবশ্য হিতে বিপরীত হয়। জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগকে হাতিয়ার করে বিজেপি শুধু যে আপের আক্রমণ ভোঁতা করে দিয়েছিল তা নয়, দিল্লির সবকটি লোকসভা আসনেই উঠেছিল গেরুয়া ঝড়। একধাক্কায় বিজেপির ভোটের হারে বেড়ে প্রায় ৫৭ শতাংশ হয়ে গিয়েছিল। অথচ ২০১৫ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ৫৪.৩৪ শতাংশ ভোট টেনেছিল আপ। বড় ধাক্কা খান কেজরি।
আরও পড়ুন : লোকসভা ভোটের পর একাধিক রাজ্যে ধাক্কা BJP, বিধানসভায় ফিকে মোদী-শাহর ক্যারিশমা?
আর তখন থেকেই কার্যত দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনের ঘুঁটি সাজানো তৈরি করা শুরু করেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী। চলে দিল্লির উন্নয়ন-পরিষেবা নিয়ে প্রচার। তবে বিজেপির শাহিনবাগ চালে কিছুটা মাত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। শাহিনবাগে রাস্তা জুড়ে আন্দোলন নিয়ে দিল্লিবাসীর ক্ষোভকে কাজে লাগানোর জন্য কেজরির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ইন্ধন জোগানোর অভিযোগ তোলে বিজেপি। শাহিনবাগ নিয়ে মেরুকরণের রাজনীতি করে দিল্লিতে দলের বৈতরণী পার করাই ছিল গেরুয়া শিবিরের লক্ষ্য।
আরও পড়ুন : সোশ্যাল মিডিয়ায় মন জিতল খুদে কেজরিওয়াল
এই পরিস্থিতিতে গত বছর শেষের দিকে প্রশান্ত কিশোরের হাত ধরেন কেজরি। সেখানেই সঞ্জীবনী পায় আপ। মেরুকরণের বিজেপি যে মেরুকরণের চেষ্টা করছে, তা কেজরির মাথায় ঢুকিয়ে দেন। কমজোরি আক্রমণ বিভাগ নিয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণ ভাঙার চেষ্টা না করে নিজের শক্তপোক্ত রক্ষণকে আরও জোরদার করার পরামর্শ দেন পিকে। তারপর থেকেই কার্যত গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকছিলেন কেজরি।
আরও পড়ুন : Delhi Election Result 2020: শেষবেলার ঝোড়া ইনিংসে জয় সিসোদিয়ার
২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দেওয়া, মহল্লা ক্লিনিক, সরকারি বাসে মহিলাদের বিনামূল্যে সফর, বাসে মার্শাল রাখা, স্কুলের পরিকাঠামোর উন্নয়ন থেকে শুরু করে প্রতিদিন বিনামূল্যে ৭০০ লিটার পানীয় জল দেওয়ার মতো আপ সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েই প্রচার সারেন তিনি। মোদী তো দূর অস্ত, শাহিনবাগ নিয়েও দূরত্ব বজায় রেখে চলেন। এরইমধ্যে মোদীকে হারানোর ডাক দেন পাকিস্তানের এক মন্ত্রী। তাঁকে কড়া জবাব দেন কেজরি। ফলে বিজেপির জাতীয়তাবাদী তাসও খুব একটা কাজ করেন। তবে জাতীয়তাবাদী তাল খেলার কম চেষ্টা করেনি বিজেপি। খোদ মোদী নির্বাচনী জনসভায় নিয়ম করে বালাকোট এয়ারস্ট্রাইক ও সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের প্রসঙ্গ টেনে আনতেন। তাতেও অবশ্য নীরবতা বজায় রাখেন কেজরি।
একনজরে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল
প্রবল প্রতিপক্ষ হলেও বিজেপির একটি অস্ত্র নিজেই ব্যবহার করেন কেজরি। বিজেপি যেভাবে এতদিন সুনিপুণভাবে ভাবাবেগ উসকে দিত, সেই কৌশল বিজেপির উপরই প্রয়োগ করেন তিনি। কেজরিকে 'আতঙ্কবাদী' বলেছিল বিজেপি। তা নিয়ে পালটা ভাবাবেগকে হাতিয়ার করে এক ঢিলে দুই পাখি মারেন তিনি। এক, কেজরির প্রতি সহানুভূতি তৈরি হয়। দুই, সুকৌশলে কেজরি এই বার্তা দেন যে যাঁরা তাঁকে সন্ত্রাসবাদী ভাবেন, তাঁরা গেরুয়া শিবিরকে ভোট দিক। অন্যরা ঝাড়ুতে ভোট দিক। যে কৌশলে বিজেপি-বিরোধী ভোট আপের ভোটব্যাঙ্কে পড়েছে বলেই মত রাজনৈতিক মহলের।
আরও পড়ুন : ভোট শতাংশ বাড়লেও দিল্লিতে কাটল না বিজেপির খরা, শাহিন বাগ নিয়ে অবস্থানে অনড় দল
অন্যদিকে, প্রচার পর্বের শেষ দিকে হিন্দুত্ববাদীদের বার্তা দিতে হনুমান চালিশা পাঠ করেন, হনুমান মন্দিরে যান। যদিও বরাবরই তিনি হনুমান ভক্ত বলে দাবি করেন কেজরি। তবে 'কৌশল' হোক বা 'ভক্তি' হোক, সেগুলি যে কেজরির পক্ষেই গিয়েছে তা প্রমাণ করেছে ভোটের হার। লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় আপের ভোট একধাক্কায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩.৬ শতাংশ। তা গত বিধানসভার থেকে কম হলেও শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সেই পারফরম্যান্স মোটেই ফেলনা নয়। আর এখানেই শেষ হাসি হেসেছেন কেজরি।
আরও পড়ুন : সোশ্যাল মিডিয়ায় মেরুকরণের রণনীতি ব্যর্থ, হার BJP-এর দুই বিতর্কিত নেতার