করোনাভাইরাস মহামারীর লকডাউনের বিরূপ প্রভাব পড়ছে অনেক পরিবারের উপর৷ আর্থিক সংকটের কারণে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার সন্তানদের কম খরচের স্কুলে স্থানান্তর করছে৷
কলকাতার বাসিন্দা বাদ্যশিল্পী সুকান্ত স্বরের ছেলে শহরের নামকরা স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র৷ করোনা মহামারীর লকডাউনের কারণে তার উপার্জন কমে গিয়েছে৷ বড় জমায়েত নিষিদ্ধ হওয়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তেমন একটা হয় না৷ আর তাই পরিবার নিয়ে আর্থিক সংকটে আছেন তিনি৷ সন্তানের স্কুলের খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁকে৷ ফলে ছেলেকে কম খরচের স্কুলে ভরতি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সুকান্ত৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘আমি পেশায় বাদ্যশিল্পী৷ লকডাউনে কারণে জমায়েত, অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় আর্থিক সংকটে আছি৷ তাই ছেলেকে নিয়ে গিয়েছি সরকারি স্কুলে - শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয়ে৷’
কোভিড অতিমারীতে অর্থনীতি আক্রান্ত হওয়ায় এমনই বেকায়দায় পড়েছেন সমাজের নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষ৷ কারও উপার্জন সামান্য কমেছে, আবার কারও উপার্জন একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে৷ আর এর মারাত্মক প্রভাব সেইসব পরিবারের সন্তানদের পড়াশোনায়৷ কারণ আর্থিক চাপে থাকা অনেক অভিভাবকের পক্ষে সন্তানের শিক্ষার খরচ মেটানো কঠিন হয়ে উঠেছে৷ পর্যবেক্ষকরা বলছেন, শহরের নামীদামী স্কুলে পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক করোনা মহামারীর সময়ে স্কুলের খরচ বহন করতে পারছে না৷ সেই কারণে স্কুল থেকে ট্রান্সফার নিয়ে নিচ্ছেন, অর্থাৎ বদলি করে কম খরচের স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে৷
সুপ্রিয় ভট্টাচার্যের ছেলেও স্কটিশ চার্চের ছাত্র৷ কলকাতার ২৫টি স্কুলের অভিভাবকদের সংগঠন ইউনাইটেড গার্ডিয়ান্স অ্যাসোসিয়েশন-এর আহ্বায়ক সুপ্রিয় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘ছেলে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে৷ পরীক্ষা মিটলেই ছাড়িয়ে নেব৷ বেশি দিন চালাতে পারব না৷’ তিনি জানান, করোনার সময়ে খরচ মেটাতে না পেরে স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুল থেকে শ-খানেক শিক্ষার্থী অন্য স্কুলে চলে গেছে৷ প্রথম সারির একাধিক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেও এমন তথ্যই পাওয়া গিয়েছে৷
জানা গিয়েছে, শহরের সেন্ট অগাস্টিন ডে স্কুলের ২৫ জনের ট্রান্সফার সার্টিফিকেটের আবেদন জমা পড়েছে৷ তাছাড়া ইন্দাস ভ্যালি ওয়ার্ল্ড স্কুলের আটজন অন্য স্কুলে যেতে চাইছে৷ মহাদেবী বিড়লা ওয়ার্ল্ড অ্যাকাডেমি ও বিড়লা ভারতীর অনেক পড়ুয়াও স্কুল ছাড়তে চেয়েছে বলে খবর পাওয়া গিছে৷ মহাদেবী বিড়লা ওয়ার্ল্ড অ্যাকাডেমির অধ্যক্ষ অঞ্জনা সাহা বলেন, ‘অনেক ছেলেমেয়ে পিতৃহারা হয়েছে৷ তাদের মায়েরা চিঠি লিখছেন, উপার্জনের কেউ নেই৷ কীভাবে খরচ চালাবেন৷’
এদিকে অভিভাবকরা মনে করছেন, স্কুল বদলের ফলে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ক্ষতি হবে৷ অতিমারীর সময় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইন পাঠদানের ব্যবস্থা করেছে৷ তবে পরিকাঠামোগত সুবিধা সরকারি স্কুলগুলোতে কম৷ আর তাই অনেক অভিভাবক কষ্ট হলেও সন্তানদের স্কুল বদল করাতে চাইছেন না। কারণ এর ফলে তাদের পড়াশোনা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অন্যদিকে তারা মানসিক চাপে পড়বে৷ পেশায় ব্যবসায়ী শুভজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের ছেলে নর্মদা হাইস্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে৷ শুভজিৎ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘সমস্যা হলেও খরচ জুগিয়ে যাচ্ছি৷ ভালো স্কুল থেকে ছেলেকে ছাড়াতে চাই না৷ তাতে পড়াশোনার ক্ষতি, সেই সাথে তার উপর মানসিক চাপ পড়বে৷’
তবে সরকারি স্কুলগুলোর পরিকাঠামো উন্নয়নের উপর জোর দিচ্ছেন শিক্ষকরাও৷ কলকাতার বাগবাজারের হরনাথ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক পদ্মশ্রী বিজেতা কাজি মাসুম আখতার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘সরকারি স্কুলের পরিকাঠামো উন্নত করতে হবে৷ শিক্ষকদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া জরুরি৷ তা হলে যে পড়ুয়ারা আসবে, তারা ভবিষ্যতে ফিরে যাবে না৷’ এটিকে বাংলা মাধ্যম স্কুলের হারানো গৌরব ফিরে পাওয়ার সুযোগ হিসেবে নিতে চাইছেন তিনি৷
এদিকে কয়েকমাস ধরে স্কুলের বকেয়া বেতন নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবক সংগঠনের মধ্যে আইনি লড়াই চলছে৷ অভিভাবকরা গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে আন্দোলন চালিয়েছেন৷ আদালত বলেছে, ফি বকেয়া থাকলেও কোনও পড়ুয়াকে বহিষ্কার করা যাবে না৷ পরীক্ষায় বসতে দিতে হবে৷ তবে এমন রায়ের পরেও কেন ছেলেমেয়েদের অন্য স্কুলে নিয়ে যাচ্ছেন বাবা-মায়েরা? অভিভাবকদের বক্তব্য, আদালত নির্দেশ দিলেও অনেক স্কুলই তা মেনে চলে না৷ তাই ছেলেমেয়েদের ট্রান্সফার করাতে বাধ্য হতে হয়৷