বিশ্বকাপকে সামনে রেখে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ছাগল ও ভেড়ার মাংস আমদানি করছে কাতার৷ ফিফা বিশ্বকাপের দৌলতে বড় বাজারের দুয়ার খুলে গেল 'হরিণঘাটা মিট'-এর সামনে৷ রোববার থেকে শুরু হচ্ছে "গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ"। আগামী চার সপ্তাহ সারা পৃথিবীর মিলনকেন্দ্র মধ্যপ্রাচ্যের কাতার। তাই সব ধরনের খাবারের আয়োজন করতে হচ্ছে স্থানীয় প্রশাসনকে। পশুর মাংসের ক্ষেত্রে তারা বেছে নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের কালো ছাগলের মাংসকে। পাঁঠার সঙ্গে ভেড়ার মাংসও রফতানি শুরু হয়েছে আরব মুলুকে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের অধীন 'ওয়েস্ট বেঙ্গল লাইভস্টক ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড'। তাদের জনপ্রিয় ব্র্যান্ড 'হরিণঘাটা মিট'। রাজ্যের সর্বত্র তাদের আউটলেট রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের পশু-পাখির মাংস বছরভর বিক্রি করে এই সংস্থাটি। এই 'হরিণঘাটা মিট'-এর বেঙ্গল গোট ও ল্যাম্বের মাংস অর্থাৎ পাঁঠা ও ভেড়ার মাংস কাতার রওনা দিয়েছে।
ভারতের অন্য স্থান, পাটনা বা পঞ্জাবের তুলনায় স্বাদে এগিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পাঁঠার মাংস। এ মাসের গোড়া থেকেই মাংস রফতানির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। দফতর সূত্রে খবর, বিশ্বকাপের জন্য প্রথম পর্যায়ে এক দশমিক দুই মেট্রিক টন পাঁঠার মাংস পাঠানো হয়৷ এক মাসে ছয় দফায় সাত টন মাংস রফতানি করা হবে। প্রাথমিক প্রক্রিয়া এখানে সম্পন্ন করে পশুর দেহ পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
রাজ্যে সংস্থার তিনটি উৎপাদন কেন্দ্রে তাই এখন ব্যস্ততা। উচ্ছ্বসিত প্রাণিসম্পদ বিকাশ মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ জানিয়েছেন, 'বছর দুয়েক ধরে কথা চলছিল। আমাদের মাংস প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র পেয়ে গিয়েছে। এখন কাতারে যাচ্ছে, এরপর সৌদি আরব, আরব আমিরশাহি, হংকং, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপ-সহ বিভিন্ন দেশে বাংলার মাংস যাবে।'
দফতর সূত্রে খবর, প্রতি বছর ১০ হাজার মেট্রিক টন মাংস বিদেশে সরবরাহ করা হবে। এতে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকার ব্যবসা হবে। ফিফা বিশ্বকাপের দৌলতে বিশ্বের আরো বড় বাজারের রাস্তা 'হরিণঘাটা মিট'-এর সামনে খুলে যাবে বলে আশায় আছেন সংস্থার কর্তারা। এ রাজ্যের একটি পণ্যের এত ভালো বিজ্ঞাপন আর কোন উপায়ে সম্ভব ছিল না বলেই মনে করছেন তারা।
বাঙালির রসনায় পাঁঠার কদরই আলাদা। প্রবাদেই আছে, 'দধির অগ্র, ঘোলের শেষ, কচি পাঁঠা, বৃদ্ধ মেষ'। এই প্রবাদের মাহাত্ম্য এ বার পাঁঠা-মেষের সূত্রে উপভোগ করবে বিশ্ববাসী। এতে খুশি 'ফুডকা' খ্যাত ফুডব্লগার ইন্দ্রজিৎ লাহিড়ি। এই ফুড ব্লগার ডয়চে ভেলেকে বলেন, 'বাংলার কোনও একটি পণ্য বিদেশে রফতানি হচ্ছে, এটাই খুব ভালো লক্ষণ। বাঙালি ব্যবসায় উন্নতি করছে। ফুটবলেও করবে, আমাদের প্রতিভা আছে।'
রসনা সংক্রান্ত লেখায় পাঠকপ্রিয় সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী বিষয়টিকে শ্লেষের দৃষ্টিতে দেখছেন। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, 'আমাদের ফুটবলের ঐতিহ্য ছিল, সেটা আস্তে আস্তে শেষ হয়ে গেছে। কোথায় আর ফুটবল খেলা হয়? তাই এখন ছাগলের মাংস বিশ্বকাপে যাবে, ফুটবলাররা খাবে, এটা শুনে বলতেই হচ্ছে, আহা!'
'সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল'— জনপ্রিয় গানের এই লাইন এখন বাঙালির কাছে বিড়ম্বনার হয়ে উঠলেও পরম্পরা হারিয়ে যায়নি। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের নামে এখনো গ্যালারি ভরে যায়। ওপার বাংলায় একই ঐতিহ্য আবাহনী-মহামেডানের। কিন্তু বাঙালির বিশ্বকাপ খেলা হয় না!
যদিও আশা ছাড়তে রাজি নন ভারতীয় দলের প্রাক্তন ফুটবলার দীপেন্দু বিশ্বাস। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, 'বাংলার মিষ্টির পর মাংসও বিশ্বের দরবারে যাচ্ছে, এটা তো ভাল খবর। ফুটবলও যাবে। ভারত অনূর্ধ্ব ১৭ পুরুষ ও মহিলা বিশ্বকাপ ফুটবল খেলেছে। সিনিয়রদের বিশ্বকাপেও ভবিষ্যতে আমরা খেলব।'
বিশ্বকাপে অংশ নিচ্ছে আরো একটি বাঙালি প্রতিষ্ঠান। কলকাতার দক্ষিণে বেহালার সংস্থা বিএমসি ইলেকট্রোপ্লাস-এর তৈরি ৩০ হাজার ট্রান্সফরমার বসেছে কাতারের স্টেডিয়ামে। সংস্থার দাবি, বিশ্বকাপের মোট চাহিদার ৫০ শতাংশ ট্রান্সফরমারই তাদের তৈরি। এতে ৩৫ কোটি টাকার ব্যবসা হবে। এগুলির সাহায্যে আলোকিত হবে বিশ্বযুদ্ধের রঙ্গমঞ্চ। রসনার তৃপ্তিতে মাঠের বাইরে কারিগর বাঙালি। কিন্তু কবে তাদের ফুটবল পায়ে দেখা যাবে বিশ্বের ময়দানে? এই প্রশ্ন রেখে শেষ হবে আরও একটি বিশ্বকাপ।