সিডনিতে শেষ টেস্ট ম্যাচটি খেলতে চেয়েছিলেন ওয়ার্নার। তাঁর সেই আশা পূরণ করেছে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। আর শনিবার দলকে জিতিয়ে টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ করলেন ওয়ার্নার। জয়ের জন্য শেষ ইনিংসে প্রয়োজন ছিল ১৩০ রান। ওয়ার্নার করলেন ৫৭ রান। সাজিদ খানের বল এলবিডব্লিউ না হলে, ম্যাচ জিতিয়েই মাঠ ছাড়তে পারতেন অস্ট্রেলিয়ার ওপেনার। সেটা না হওয়ার আফসোসটা অবশ্য তাঁর থেকেই গেল।
পাকিস্তানের দেওয়া ১৩০ রানের লক্ষ্য ৮ উইকেট অক্ষত রেখে চতুর্থ দিনের দ্বিতীয় সেশনেই ছুঁয়ে ফেলে অস্ট্রেলিয়া। স্বভাব সুলভ ব্যাটিংয়ে ৫৭ রান উপহার দিয়ে বিদায়ী টেস্ট স্মরণীয় করে রেখেছেন ওয়ার্নার। সাজিদ খানের বলে তাঁকে এলবিডব্লিউ আউট দিলে, ডিআরএস নেন তিনি। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়তে না পারার আফসোস নিয়েই ড্রেসিংরুমে ফিরতে হয় ওয়ার্নারকে। তিনি আউট হয়ে ফেরার পথে আবেগপ্রবণ ছিল এসসিজি-র পুরো গ্যালারি। তাঁর বিদায়কালে এসসিজির দর্শকেরাও চোখ মুছেছেন, দাঁড়িয়ে সম্মান জানিয়েছেন। সম্মান জানিয়েছেন নিজের এবং বিপক্ষ দলের প্লেয়াররা। শেষ বার টেস্ট খেলা ওয়ার্নার নিজের গ্লাভস এবং হেলমেট তুলে দেন এক খুদে ভক্তের হাতে। স্টেডিয়াম জুড়ে করতালির মাঝেও কোথাও একটি বিষন্নতার সুর স্পষ্ট ধরা পড়ছিল।
ঘরের ছেলের বিদায় উপলক্ষে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এসসিজি) খেলা দেখতে আসা দর্শকদের ম্যাচ শেষে মাঠে আসার সুযোগ দেওয়া হয়। তাঁদের সাক্ষী রেখেই হয়েছে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানও। ক্রিকেট মাঠে আগে গ্যালারি থেকে মাঠে ঢুকে পড়তেন দর্শকেরা। ১৯৮৩ বিশ্বকাপ ফাইনালে লর্ডসে ভারতের জয়ের পরেও দর্শকরা মাঠে ঢুকে পড়েছিলেন। কিন্তু এখন ক্রিকেটারদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে গ্যালারি থেকে মাঠে ঢোকা পুরোপুরি নিষিদ্ধ। কিন্তু ওয়ার্নার আবেগে সিডনিতে সেই নিয়ম ভাঙল। সিডনি ভাসল আবেগে।
ওয়ার্নারের টেস্ট রেকর্ড এখন আর কারওরই সম্ভবত অজানা নয়। ১১২ ম্যাচে ২০৫ ইনিংসে ৪৪.৫৯ গড়ে ৮৭৮৬ রান করেছে তিনি। ২৬টি সেঞ্চুরি এবং ৩৭টি অর্ধশতরান রয়েছে তাঁর। অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট ইতিহাসে রানের হিসেবে পঞ্চম স্থানে রয়েছেন ওয়ার্নার। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার ওপেনারদের মধ্যে আর কেউ টেস্টে ওয়ার্নারের মতো এত বেশি রান করতে পারেননি।
আরও পড়ুন: লজ্জায় ডুবলেন বাবররা, পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করে ওয়ার্নারের বিদায়ী সিরিজকে রত্নখচিত করে তুলল অজিরা
গ্যালারিতে বসে থাকা ওয়ার্নারের স্ত্রী ক্যানডিস ওয়ার্নার সন্তানদের সামলাতেই ব্যস্ত ছিলেন। একটু পর সবাইকে নিয়ে তিনিও মাঠে নেমে আসেন। সন্তানদের জড়িয়ে ধরেন ওয়ার্নার। ম্যাচ শেষে বলেন, ‘ওদের (পরিবারের) সাহায্য ছাড়া আমি যেটা করি, সেটা করতে পারতাম না। মা-বাবার অবদানও কম নয়, তাঁরা আমার সুন্দর বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করেছেন। ভাই স্টিভ, আমি তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছি। এরপর ক্যানডিস এল আমার জীবনে।’
আরও পড়ুন: বিদেশি ক্রিকেটাররা ভারতে এলে যেন আর অভিযোগ না করেন- পিচ নিয়ে কড়া দাওয়াই ইরফানের
আবেগ প্রবণ ওয়ার্নার না থেমেই বলে চলেছিলেন, ‘আমার পরিবার অসাধারণ। ওদের সঙ্গে প্রতিটি মুহূর্ত আমি উপভোগ করি। ওদের খুব ভালোবাসি এবং আমি এটা নিয়ে বেশি কথা বলব না, আবেগতাড়িত হয়ে পড়ব। তবে ক্যানডিসকে ধন্যবাদ, ও আমার জন্য যা করেছে, তুমিই আমার জগৎ।’ ওয়ার্নার এ কথাগুলো বলার সময় মাঠে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়েরা। কথাগুলো বলার সময়ে ওয়ার্নার দেখছিলেন তাঁর সতীর্থদের। হয়তো মনে মনে যন্ত্রণা অনুভব করছিলেন- সাদা জার্সিতে তিনি আর কখনও খেলতে নামবেন না!
ওয়ার্নার সতীর্থদের দিকে তাকিয়েই বলছিলেন, ‘আমার মনে হয় যখন ওদের মাঠে নামতে দেখব, কিন্তু আমি খেলব না, তখন একটু আবেগতাড়িতই হব। তবে যেটা বলেছি, এই দলটা দারুণ। আমাদের বেশির ভাগের বয়সই ত্রিশের ওপাশে। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা আরও তরুণ না হলেও, এই দলটা কর্মক্ষম, বিশ্বমানের এবং অসাধারণ।’
ওয়ার্নার নিজে এই দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে, ভুলতে পারবেন না অস্ট্রেলিয়া সহ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা তাঁর ভক্তরাও। কথা বলার সময়ে ওয়ার্নারকে বাঁ-চোখটা মুছতে দেখা যায়। প্রবল আবেগে শেষ পর্যন্ত আর ধরে রাখতে পারেননি চোখের জল। ওয়ার্নারের হাত ধরে বিশ্ব টেস্ট ক্রিকেটে সমাপ্তি হল এক বিশাল অধ্যায়েরও।