ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম দুই টেস্টের জন্য ইতিমধ্যে ১৬ জনের ঘোষণা করে দিয়েছে ভারত। শুক্রবার রাতে যে দল ভারত ঘোষণা করে, তাতে নিঃসন্দেহে অনেক চমক ছিল। ইশান কিষাণকে বাদ দেওয়া হয়। তাঁর পরিবর্তে নতুন মুখ হিসেবে এই স্কোয়াডে ডাক পেয়েছেন উইকেটকিপার ব্যাটার ধ্রুব জুরেল। এটা ছিল ভারতীয় দলের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ধ্রুব জুরেল সব সংস্করণ মিলিয়েই প্রথম বার ডাক পেলেন জাতীয় দলে।
লোকেশ রাহুলের ব্যাকআপ কিপার হিসেবে দলে রাখা হয়েছে কে এস ভরতকে। উত্তরপ্রদেশের ২২ বছর বয়সী জুরেলকে নেওয়া হয়েছে তৃতীয় বিকল্প হিসেবে। গত বছর ৫ এপ্রিল আইপিএলে পঞ্জাব কিংসের বিপক্ষে ‘ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার’ হিসেবে এই ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে অভিষেক হয়েছিল তাঁর। সেই ম্যাচে জয়ের জন্য ৩০ বলে ৭৪ রান দরকার ছিল রাজস্থান রয়্যালসের। জেসন হোল্ডার থাকতে রাজস্থান কেন জুরেলকে মাঠে নামাল, তখন এই প্রশ্নও উঠেছিল। কিন্তু রাজস্থান সেই ম্যাচে ৫ রানে হারলেও, ১৫ বলে ৩২ রান করে জুরেল নজর কেড়েছিলেন।
ক্রিকেটার হয়ে ওঠার পথে জুরেল যখন যেখানে যে ভাবে সুযোগই পেয়েছেন, সেটাই কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন। ভারত অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে নেতৃত্ব দিয়ে ২০১৯ এশিয়া কাপ জেতানো এই ক্রিকেটার ক্যারিয়ারের ছয় নম্বর প্রথম শ্রেণির ম্যাচেই ২৪৯ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেছিলেন। অথচ শৈশবের এক দুর্ঘটনার পর তাঁর ক্রিকেটার হওয়ার কথাই ছিল না! ৫ বছর বয়সে আগ্রায় বাসের চাকার তলায় চলে গিয়েছিল তাঁর বাঁ-পা। প্লাস্টিক সার্জারি করাতে হয়েছিল। ছোট থেকেই সেই লড়াইটাই বোধহয় তাঁকে যাবতীয় প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়তে শিখিয়েছে।
আরও পড়ুন: প্রথম দুই টেস্টে ইশানের বদলে ঋদ্ধি নন, আস্থা জুরেলে, বাদ প্রসিধ, আনফিট শামির জায়গায় আবেশ
একটা সময়ে জুরেল বাবার মতো সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ারও স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর বাবা নেম সিং জুরেল কার্গিল যুদ্ধের বীর যোদ্ধা। বাবাকে দেখেই সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে চেয়েছিলেন ধ্রুব জুরেল। গত বছর এপ্রিলে ইএসপিএনক্রিকইনফো-কে দেওয়ার এক সাক্ষাৎকারে নিজের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার গল্প বলেছিলেন বলতে গিয়ে জুরেল দাবি করেছিলেন, ‘আমার বাবা সামরিক বাহিনীতে ছিলেন। ক্রিকেট খেলায় কখনও আমাকে তিনি সমর্থন দেননি। চেয়েছিলেন, সরকারি চাকরি করব, ভবিষ্যৎ নিরাপদ হবে।’
এই নিয়ে একটি মজার এক গল্পও বলেছেন জুরেল। তিনি জানিয়েছিলেন, ‘একদিন বাবা সংবাদপত্র পড়ার সময়ে হঠাৎ করেই বলেন, তোমার নামেই এক ক্রিকেটার আছে, যে অনেক রান করেছে। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সেই ক্রিকেটারটি যে আমি, সেটা তাঁকে কী ভাবে বলব বুঝতে পারছিলাম না। তিনি আমাকে ক্রিকেট ছাড়তে বলতে পারেন, সেই ভয়টা ছিল।’
ক্রিকেটই যে তাঁর ভবিষ্যৎ, সেটা বুঝতে জুরেলের বেশি দিন লাগেনি। তবে ১৪ বছর বয়সে কঠিন বাস্তবতারও মুখোমুখি হয়েছিলেন। মা–বাবাকে ক্রিকেট খেলার সরঞ্জাম কিনে দিতে বলেছিলেন। এর জবাবে তাঁকে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে বলেছিলেন বাবা। কিন্তু মায়ের মন মানেনি। ছেলের ইচ্ছাপূরণ করতে গলার সোনার চেন বিক্রি করে দিয়েছিলেন তাঁর মা।
গত বছর জুনে হিন্দুস্তান টাইমসকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে জুরেল সেই গল্প বলেছিলেন, ‘বাবাকে বলেছিলাম একটি কাশ্মীরি উইলো ব্যাট কিনে দিতে। বাবা ব্যাটটা কিনে দিলেও, দামের কারণে ক্রিকেট খেলার পুরো সরঞ্জাম কিনে দিতে পারেননি। আমি নিজেকে বাথরুমে আটকে বলেছিলাম, সব সরঞ্জাম কিনে না দিলে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাব। এতে আমার মা আবেগতাড়িত হয়ে গলার সোনার চেন বাবার হাতে তুলে দিয়ে, সেটা বিক্রি করে খেলার সরঞ্জাম কিনে আনতে বলেছিলেন। সেই সময়ে খুব উত্তেজনা বোধ করলেও. বড় হওয়ার পর বুঝেছিলাম, এটা কত বড় ত্যাগ ছিল। এবং সেটা বোঝার পর থেকেই আরও বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে পড়ি।’
পঞ্জব কিংসের বিরুদ্ধে আইপিএলে তাঁর ১৫ বলে অপরাজিত ৩২ রানের ইনিংস খেলে জুরেল নিজের জাত চেনান। শিমরন হেতমায়ের, জেসন হোল্ডারের মতো খেলোয়াড়দের থেকে তিনি প্রশংসা পান। একজন ফিনিশার হিসেবে তিনি নিজের একটি আলাদা জায়গা তৈরি করেন। তবে এ সবের মাঝে ধ্রুব জুরেলের কাছে বড় প্রাপ্তি ছিল তাঁর বাবার কথা। তরুণ কিপার-ব্যাটার জানান, ‘ওঁরা (বাবা-মা) জয়পুরে একটি আইপিএল ম্যাচ দেখতে এসেছিলেন। বাবা মায়ের দিকে ফিরে বলেছিলেন, তেরে সোনে কি চেন উসুল হো গয়ি আজ (তোমার সোনার চেন পরিশোধ করা দিয়েছে)।’
গত মাসে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ভারত ‘এ’ দলের হয়ে চার দিনের ম্যাচে অর্ধশতরান করেছিলেন জুরেল। ১৫টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ১৯ ইনিংসে ৪৬.৪৭ গড়ে তাঁর রান ৭৯০। লোকেশ রাহুল দলে থাকায় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একাদশে জুরেলের জায়গা পাওয়ার সুযোগ খুবই কম। তবে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়াকে আপাতত স্বপ্নপূরণ তো বলাই যায়!