জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রটি উত্তরবঙ্গের এক গুরুত্বপূর্ণ লোকসভা কেন্দ্র. ১৯৬৭ সাল থেকে এই সংসদীয় ক্ষেত্রে লোকসভা নির্বাচন হয়ে আসছে। এই আসনটি বর্তমানে তপশিলি জাতি বা তপশিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত নয়। জঙ্গিপুর শহরে এই লোকসভা কেন্দ্রের সদর দফতর অবস্থান করছে। ২০১৯ সালের প্রেক্ষিতে এই কেন্দ্রের মোট ভোটদাতা ছিলেন ১৩ লক্ষ ৯১ হাজার ৬০০ জনের বেশি মানুষ। মুর্শিদাবাদ জেলার বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত বিধানসভা কেন্দ্রগুলি হল সুতি বিধানসভা কেন্দ্র, জঙ্গিপুর বিধানসভা কেন্দ্র, রঘুনাথগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্র, সাগরদিঘী বিধানসভা কেন্দ্র, লালগোলা বিধানসভা কেন্দ্র, নবগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্র এবং খরগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্র। এর মধ্য নবগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্র এবং খড়গ্রাম বিধানসভা কেন্দ্র দুটি তপশিলি জাতিদের জন্য সংরক্ষিত।
এবারে এখানে লড়াই তৃণমূলের বর্তমান সাংসদ খালিলুর রহমান, কংগ্রেসের মোর্তাজা হোসেন ও বিজেপির ধনঞ্জয় ঘোষ। এই আসন জিততে মরিয়া কংগ্রেস, তাই ইন্ডিয়া জোট একেবারে এককাট্টা হয়ে প্রচার করেছে এখানে। অন্যদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যয় প্রচার করেছেন খালিলুর রহমানের জন্য। যাতে কোনওভাবেই মুসলিম ভোট না ভাগ হয়, সেই জন্য তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন জঙ্গিপুরের মানুষদের। তবে এই ভোট কাটাকুটির অঙ্কেই আশা জিইয়ে রাখছে বিজেপির। তবে গতবার যেরকম বিপুল মার্জিনে তৃণমূল জিতেছে ও বিধানসভাতে যেখানে সবকটা আসনই তাদের দখলে, এই কেন্দ্রে জোড়াফুল ফোটার সম্ভাবনাই প্রবল। সাত মে তৃতীয় দফায় ভোটগ্রহণ এখানে।
একনজরে দেখে নেওয়া যাক লোকসভা নির্বাচনের ইতিহাসে ১৯৬৭ সাল থেকে সাম্প্রতিকতম বছরগুলিতে কেমন ছিল এই কেন্দ্রের জনমত। ১৯৬৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে জঙ্গিপুর কেন্দ্র থেকে জয়যুক্ত হন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের এইচএল হক। তিনি ৫১ হাজার ৬০০টির বেশি ভোটে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করেন। ১৯৭১ সালের নির্বাচনে এই আসনটি ফের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নিজেদের দখলে রাখতে সক্ষম হয়। লুৎফল হক এই কেন্দ্রটি থেকে ৪৯ হাজার ৩৫৬ টি ভোটে পরাজিত করেন নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে। ১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ভোটের শেয়ার অনেকটা কমে গিয়ে ভারতীয় লোকদল পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ২১.২ শতাংশ ভোট পায়। এছাড়া সিপিআই(এম)ও বেশ ভালো ফলাফল করে নির্বাচনে। জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রটি ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে হাতছাড়া হয় জাতীয় কংগ্রেসের। কংগ্রেসকে হারিয়ে সিপিআইএমের শশাঙ্কশেখর সান্যাল ২০০০-এর কিছু বেশি ভোটে জয়যুক্ত হন। ১৯৮০ সালের লোকসভা নির্বাচনে ফের ভারতীয় লোকদল প্রাসঙ্গিকতা হারালে জাতীয় কংগ্রেসের ভোটের শেয়ার গিয়ে দাঁড়ায় ৩৬.৫ শতাংশে, এছাড়া সিপিআইএমের ভোটের শেয়ার দাঁড়ায় প্রায় ৪০ শতাংশের কাছাকাছি। এই নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া মার্কসবাদীর পক্ষ থেকে জয়নাল আবেদীন ৭২ হাজারের বেশি ভোটে জয়যুক্ত হন এই কেন্দ্র থেকে।
১৯৮৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেস ৪৮.২ শতাংশ ভোট পায় রাজ্য জুড়ে। আসনের ক্ষেত্রেও ১৬টি আসন দখল করে তারা। তবে জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রটি সিপিআইএম নিজেদের দখলেই রাখে। ফের এই কেন্দ্র থেকে জয়যুক্ত হন জয়নুল আবেদীন। ১৯৮৯ ও ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেসের ভোটের শেয়ার কমে দাঁড়ায় ৪১.৪ শতাংশ এবং রাজ্য জুড়ে সিপিআইএমের ভোটের শেয়ার বেড়ে দাঁড়ায় ৩৮.৪ শতাংশ। জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে জয়ের ধারা অব্যাহত রেখে সাংসদ নির্বাচিত হন জয়নুল আবেদীন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রটি ফের নিজেদের দখলে নেয় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মহম্মদ ইদ্রিস। ১৩ হাজার ১২২টি ভোটে জইয় লাভ করেন তিনি। ১৯৯৮ সালের নির্বাচনে দেখা যায় রাজ্য জুড়ে ভারতীয় জনতা পার্টির ভোটের শেয়ার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০.২ শতাংশ। সিপিআইএম ৩৫.৪ শতাংশ এবং জাতীয় কংগ্রেস ২৪.৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিল এই নির্বাচনে। ১৯৯৮-এর লোকসভায় ফের এই আসনটিতে পার্টি অফ ইন্ডিয়া মার্কসবাদীর পক্ষ থেকে আব্দুল হাসনাত খান জয়যুক্ত হন। ১৯৯৯ সালের নির্বাচনে আত্মপ্রকাশ ঘটে তৃণমূল কংগ্রেসের। জাতীয় কংগ্রেসের ভোটের শেয়ার কমে দাঁড়ায় ১৩.৩ শতাংশ এবং তৃণমূল কংগ্রেস ২৬ শতাংশ ভোট পায় জঙ্গিপুর কেন্দ্রটিতে। সিপিআইএমের পক্ষ থেকে ফের জয়যুক্ত হন আব্দুল হাসনাদ খান।
২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রটিতে হেভিওয়েট প্রার্থী প্রণব মুখার্জি জয়যুক্ত হন জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে। ৩৬ হাজার ৮০০-এর বেশি ভোটে পরাজিত করেন সিপিআইএমকে। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ৩১ শতাংশ ভোট পায় তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিআইএমের আসন কমে দাঁড়ায় ৯টিতে। জাতীয় কংগ্রেস ছয়টি আসন পায় এবং তৃণমূল কংগ্রেস ১৯টি আসনে জয়যুক্ত হয়। এই লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস ইউপিএ সরকারের সঙ্গে জোটবদ্ধ ছিল। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে দেশজুড়ে ক্ষমতায় আসে ভারতীয় জনতা পার্টি। পশ্চিমবঙ্গে তারা দুটি আসন পেলেও তাদের ভোটের শেয়ার বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ শতাংশ৷ জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রে এই নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে প্রণব মুখার্জির পুত্র অভিজিৎ মুখার্জি জয়যুক্ত হন ৮ হাজার এর কাছাকাছি ভোটে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসকে টেক্কা দিয়ে ভালো ফলাফল করে ভারতীয় জনতা পার্টি। এই আকস্মিক উত্থান পর্বে তারা প্রায় ৪০.৬ শতাংশ ভোট পায় এবং আসন পায় ১৮টি। সিপিআইএমের আসন সংখ্যা শূন্য হয়ে গেলেও জাতীয় কংগ্রেস তাদের দু’টি আসন ধরে রেখেছিল। তবে জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রটি হাতছাড়া হয় তাদের। তৃণমূলের খালিদুর রহমান এই কেন্দ্রটি থেকে জয়যুক্ত হন ২ লক্ষ ৪৫ হাজারেরও বেশি ভোটে।
এবার জেনে নিন ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই আসনটির জনমত কোন দিকে ছিল। সুতি বিধানসভা ক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেস জয়যুক্ত হয়। রঘুনাথগঞ্জ বিধানসভা ক্ষেত্রে আফরুজ্জামান জয়যুক্ত হন তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে। তিনি ৯৮ হাজারের বেশি মার্জিনে জয়যুক্ত হন। বহু চর্চিত সাগরদিঘী বিধানসভা কেন্দ্রে সুব্রত সাহা তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে জয়যুক্ত হন পঞ্চাশ হাজারের বেশি ভোটে। পরবর্তী কালে সাগরদিঘীতে উপনির্বাচনের মাধ্যমে বায়রন বিশ্বাস বিধায়ক পদে বসেন। লালগোলা বিধানসভা কেন্দ্রটি তৃণমূল কংগ্রেসের মহম্মদ আলি নিজের হাতে রাখেন। প্রায় ষাট হাজারের বেশি ভোটের মার্জিনে পরাজিত করেন নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে। ফারাক্কা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন মনিরুল ইসলাম। খরগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রটিতে তৃণমূল কংগ্রেসের আসিস মারজিদ জয় যুক্ত হন ৩৩ হাজারের বেশি ভোটে অর্থাৎ লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনের সাম্প্রতিক বছরগুলিতে জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রের দখল রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে।