প্রতিদিন প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষ থেকে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অনেক মেক-আপ আর্টিস্ট, ফ্যাশন ডিজাইনার, হেয়ার স্টাইলারদের সঙ্গে আকছার ঘটে চলেছে নানা রকম অপ্রীতিকর ঘটনা। এমনকি ঋতুপর্ণ ঘোষের মতো ব্যক্তিত্বও বাদ পড়েননি, ‘খিল্লি’র তালিকায় রয়েছেন তিনিও! এবার নাকি এমনই ঘটনার শিকার হলেন শিল্পী সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। অভিযোগ, তিনি লাঞ্ছিত হন বেঙ্গল রোয়িং ক্লাবে। এই নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার শুরু হয়েছে নিন্দার ঝড়। ঘটনাটি নিয়ে অবশেষে মুখ খুলল ক্লাব কর্তৃপক্ষ। সামনে আনল ঘটনার ভিডিয়ো ফুটেজ।
১৬-ই জুন থেকে মেন্টাল হেলথ অ্যাক্টিভিস্ট রত্নাবলী রায় সোশ্যাল মিডিয়ায় সোচ্চার হয়েছেন সুজয়ের অপমানের প্রতিবাদে। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে বিষয়টিতে আলোকপাত করেন। তাঁর বিবরণ অনুযায়ী ঘটনাটি এরকম,
রত্নাবলীর রায়ের পোস্ট অনু্যায়ী
প্রতিদিন বিকেলে নিয়ম করে সুজয়ের হাঁটার অভ্যেস। সেইমতো ১৫ জুন বিকেলে বেরিয়েছিলেন হাঁটতে, অবশ্যই মাস্ক পরে এবং স্যানিটাইজার সঙ্গে নিয়ে। সার্দান অ্যাভিনিউ থেকে বেঙ্গল রোয়িং ক্লাবের দিকে যান তিনি। সেখানে পৌঁছে তিনি ক্লাবের অন্দরে যাওয়ার অনুমতি চাইলে গেটের দারোয়ান তাঁকে প্রবেশের অনুমতি দেন। টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল বলেই তিনি ওই ক্লাবে গিয়েছিলেন।
টয়লেটে ঢুকতে যাবেন সেই সময় ক্লাবের একজন গ্রুপ ডি স্টাফ তাঁকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতে শুরু করেন। যত দূর জানা যায় তাঁর নাম সঞ্জয় মান্না। সুজয়কে হিজড়া বলে সম্বোধন করেন এবং কে তাঁকে ক্লাবে ঢোকার অনুমতি দিয়েছে, বা তিনি এখানে কী করছেন? কারণ এটা হিজড়েদের ক্লাব নয়, ইত্যাদি বলে অকথ্য ভাষায় সুজয়কে ‘তুই’ সম্বোধন করে গালাগাল করতে থাকেন ক্লাবের ওই কর্মী। সুজয় বারবার সেই কর্মী গালাগাল না করে ভদ্রভাবে কথা বলতে অনুরোধ করেন। তিনি অনুমতি নিয়ে ক্লাবে প্রবেশ করেছেন সেটাও জানান। যদিও এতে কোনও কাজ হয়নি।
সুজয়কে আরও কয়েকজন ক্লাবের কর্মী মিলে প্রায় টানতে টানতে, ধাক্কা মেরে, অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করতে করতে ক্লাবের বাইরে বার করে দেন। যদিও ঘটনাস্থলের বেশ কাছেই বসেছিলেন ক্লাবের একজন সদ্যস্য। সেই সদ্যস্য কোনও প্রতিবাদ করেননি।
রত্নাবলী রায় আরও বলেছেন, ‘সুজয়কে ডিফেন্ড করার জন্য আমায় প্রয়োজন নেই | সুজয় একাই একশ | এই লেখা সুজয়কে কেন্দ্র করে, কিছু মানসিকতাকে প্রশ্ন করা? কিন্তু যারা সুজয় নয়……! উনি টয়লেট যেতে চেয়েছেন। যেতেই পারেন। খাবারও দাবি করেননি বিনে পয়সায়, মদ্যপানও করতে চাননি, চেয়েছিলেন পরিষ্কার একটা টয়লেট। এই ঘটনা কয়েকটি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে মনে।
১) শহরে পরিষ্কার পাবলিক টয়লেট নেই কেন?
২) একেই কি বলে মাত্রাছাড়া অসহিষ্ণুতা?
৩) হিজড়ে বলে গাল দেওয়া, যেন হিজড়েরা মানুষ নন? এটা কি তবে ‘নর্মাল ’?
৪) হিংসা,গণপিটুনি গায়ে হাত তোলা কি তবে এখনকার কলকাতার রেওয়াজ ? তার থেকেও বড় যে ভয় দানা বেঁধেছে সেটা, কলকাতা শহরও কি তাহলে মৌলবাদী চিন্তার শিকার হল? যে শহর আগে গর্ব করে বলত, এখানে জাতপাত, ছোঁয়াছুঁয়ি, ধর্মভেদ নেই, সেখানেই এই কাণ্ড! আমরা তো জোর গলায় বলি, মানে বলতাম , এ শহর বিভিন্নতাকে উদযাপন করে, এ শহর সবার জন্য নিরাপদ, সেফ, সত্যিই কি তাই? আসুন মনের ভিতরে চোখ মেলে দেখি | ’
এই ঘটনা জানার পর কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন সুজয় প্রসাদ টয়লেটে যাওয়ার সময় মাস্ক ব্যবহার করেন নি, সেই থেকেই হয়ত এই ঝামেলার সুত্রপাত! এর জবাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনি পোস্ট করে জানিয়েছেন,
সুজয় প্রসাদের পোস্ট অনুযায়ী
‘আমি বাথরুমে মাস্ক পরে ঢুকি না তাই সেদিন ও যাইনি। ভবিষ্যতেও যাবো না। অমানবিক বা অভব্য ব্যবহার কেউ করলে আমি তেড়ে যাই এবং আবার যাবো। অপমান আমার নয়। এমনকি ঐ Group D স্টাফদেরও নয়--সেদিন যারা আমায় অপমান করেছিলেন। এটা মানবিকতার অপমান।
আমার কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা রইলো এই সব বন্ধুদের জন্য যারা আমায় মেসেজ করেছে, ফোন করেছে, সাহায্য করতে তৎপর হয়েছে, ট্যাগ করে আমায় নিয়ে পোস্ট করেছে। BRC ক্লাব কর্তৃপক্ষ থেকে Col. T.C.BERA আমায় ফোন করে ক্ষমা চেয়েছেন তাদের এই দুর্ব্যাবহারের জন্য। আমি তাদের ক্ষমা করেছি বটেই , কিন্তু এই ঘটনাটি ভুলবো না সেটাও জানিয়েছি। রত্নাবলী রায় এবং বাপ্পাদিত্যর কাছে ঋণী রইলাম। ওদের কাছে মনুষ্যত্বের নতুন সংজ্ঞা শিখলাম।
এই পর্যন্ত ঘটনাটা শুনলে মনে হবে, এ কোন জীর্ণ সমাজে বাস করি আমরা! যেখানে আজও এই ধরণের অমানবিক অসভ্যতা ঘটে? তাও আবার বেঙ্গল রোয়িং ক্লাবের মতো অভিজাত ক্লাবে! সুজয়ে এবং রত্নাবলীর পোস্টের পর এই ঘটনার প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়া।
আমরা হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করেছিলাম বেঙ্গল রোয়িং ক্লাবের জেনারেল ম্যানেজার কর্নেল তাপস বেরার সঙ্গে। কী ঘটেছিল সেদিন , জানতে চাওয়ায় তিনি যা বললেন তাতে আমরাও হতবাক! রইল ঘটনার বিবরণ। এবং সিসি টিভির ভিডিও ফুটেজ।
কর্নেল তাপস বেরা (রিটায়ার্ড). জেনারেল ম্যানেজার বি-আর-সি
দায়িত্ব সহকারে ক্লাব পরিচালনা করছি, আপনারা বাইরেও খবর নিতে পারেন এখনকার পরিবেশ সম্বন্ধে। ক্লাবের সামনের এই রাস্তা দিয়ে অনেক সেলিব্রেটিই হাঁটতে আসেন, কোনও সময় তাঁদেরও টয়লেট যাওয়ার প্রয়োজন হলে ক্লাবে এসে অনুমতি নিয়ে টয়লেটে যান। আমরা সেটা অ্যালাও করি। যাঁরা আসেন তাঁরা সবাই যে ক্লাবের মেম্বার এমনও নয়। এটা একটা মানবিক বিষয়, কারও প্রয়োজন পড়লে তিনি একটু অনুমতি নিয়ে ক্লাবের টয়লেট অবশ্যই ব্যাবহার করতেই পারেন। আজ পর্যন্ত কারও সঙ্গে কোনও অপ্রীতিকর কিছু ঘটেনি।
প্রথমত সুজয় বাবু সেদিন টয়লেটে যাওয়ার আগে কারও কোনও অনুমতি নেননি। মূল দরজায় গার্ডকে বলে ভিতরে প্রবেশ করেন, কেন যাচ্ছেন সে বিষয়ে অবশ্য কিছু বলেননি। তারপর রিসেপশনে না গিয়ে সোজা টয়লেটের দিকে চলে যান। তিনি মাস্ক পরে ছিলেন না, তাই একজন বয়স্ক গার্ড তাঁকে বাধা দেন। সেখান থেকেই কথা কাটাকাটি শুরু। অত্যন্ত অসভ্যের মতো কথাবার্তা বলতে থাকেন সুজয়। অন্যান্য সিকিউরিটি গার্ডরাও সেখানে এসে সুজয় বাবুকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু কোনও লাভ হয় না।
যেই গার্ড ওঁকে গালাগালি করেছে বা মারতে গিয়েছে বলে উনি দাবি করছেন, সেই গার্ড এখানে গত ৩০ বছর ধরে কাজ করছেন। ক্লাবের ঐতিহ্য সম্বন্ধে এখানকার কর্মীরা যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। একজন বয়স্ক মানুষের ওপর এই ধরণের দোষ আরোপ করা খুবই অন্যায়। আর তাছাড়া ক্লাবে কিন্তু মেম্বার ছাড়া অন্য কারও টয়লেট ব্যাবহার করার অনুমতি নেই। এবং মাস্ক ছাড়া ক্লাবে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। উনি সেলেব বলে একজন অতি সাধারণ সিকিউরিটি গার্ডকে যা খুশি বলবেন? প্রত্যেকটি গার্ডের সঙ্গে সুজয় বাবু খুব খারাপ ভাষায় কথা বলতে থাকেন, এমন কি তিনিই প্রথম গায়ে হাত তুলতে যান। আমার কথা বিশ্বাস না হলে ভিডিয়ো ফুটেজ দেখে আপনারাই বিচার করুন।
আমি চেয়েছিলাম, যা হয়েছে বিষয়টা কথা বলে মিটিয়ে নিতে। মাথা গরম করে অনেক সময় মানুষ ভুল কথা বলেন, খারাপ আচরণ করে থাকেন। সুজয় বাবু যদি ভিডিওটা তখন দেখতেন তাহলে বুঝতেন যে তিনি এখন যা প্রমাণ করতে চাইছেন তা সবটাই মিথ্যে। বিষয়টাকে আমি গুরুত্ব দিতে চাইনি। ব্যক্তিগত ভাবে সুজয় বাবুকে আমি ফোন করেছিলাম। বলেছিলাম, যা হয়েছে তার জন্য আমরা দুঃখিত। ক্লাবে আসার আমন্ত্রণও জানিয়েছিলাম। কিন্তু উনি ক্রমাগত বিষয়টিকে অন্যদিকে নিয়ে চলেছেন। আমাদের ক্লাবের গার্ডের কোনও দোষ নেই। কেউ তাঁকে গালাগালিও দেয়নি। যখন দেখা গেল উনি কারও কথা শুনছেন না, তখন সবাই তাঁকে ক্লাব থেকে চলে যেতে বলেন। আমার তো মনেহয় ‘হিজড়া ’ শব্দটা উনি নিজের নামের সঙ্গে জড়িয়ে মানুষের কাছে পাবলিসিটি পেতে চাইছেন, একটা সিম্প্যাথি ক্রিয়েট করছেন। আসলে উনি নিজেই হিজড়েদের অপমান করছেন। কারণ এই বিষয়টা আলাদা করে কোনও লিঙ্গের বিষয় নয়। এখানে নারী পুরুষ বা তৃতীয় লিঙ্গ যাই হোক না কেন, নিয়ম সবার জন্য এক। আমরা সবাইকে কেবলমাত্র মানুষ হিসেবেই বিচার করি।