ইতিহাসের পাতা ওলটালে এমন অনেক গল্প জানা যায় যা আমাদের শিহরিত করে তোলে। যে সমস্ত মনীষীরা আমাদের কাছে প্রণম্য সেই সমস্ত মনীষীদের একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক কেমন ছিল তা অনেকটাই আমাদের কাছে অজানা। আজ সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিনে ফিরে দেখা, তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পর্ক। কীভাবে এই দুই প্রবাদপ্রতিম মনীষীর প্রথম আলাপ তৈরি হয়েছিল সেই ইতিহাস জেনে নিন।
সত্যজিৎ রায় এবং রবি ঠাকুরের বয়সের পার্থক্য ছিল ৬০ বছর। খুব স্বাভাবিকভাবেই বন্ধুত্বপূর্ণ কোনও সম্পর্ক যে গড়ে উঠবে না তা বলাই বাহুল্য। তবুও তাঁদের মধ্যে এমন কিছু মেলবন্ধন ঘটেছিল যা পরবর্তীকালে তৈরি করে ইতিহাস। জন্মসূত্রেও ভীষণভাবে মিল ছিল দু’জনের মধ্যে। দু’জনের জন্ম বৈশাখ মাসে।
পারিবারিক দিক থেকেও বহু দিনের সম্পর্ক রায় এবং ঠাকুর পরিবারের। সত্যজিতের পিতামহ উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম একজন। শুধু তাই নয়, সুকুমার রায় ছিলেন রবি ঠাকুরের স্নেহের পাত্র। স্বাভাবিকভাবেই সত্যজিতের প্রতি যে রবি ঠাকুরের ভালোবাসা থাকবে তা বলাই বাহুল্য।
পারিবারিক সূত্রে যোগাযোগ থাকলেও সত্যজিতের যখন ১০ বছর বয়স, তখন প্রথম রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। দেখা হয় শান্তিনিকেতনের পৌষমেলায়। মা সুপ্রভা রায়ের সঙ্গে গুরুর আশীর্বাদ নিতে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন ছোট্ট মানিক। রবি ঠাকুরের সামনে অটোগ্রাফের খাতা বাড়িয়ে দিতেই তিনি সেটি সই না করেই সঙ্গে করে নিয়ে যান উত্তরায়ণে।
পরের দিন অটোগ্রাফের সেই খাতাটি রবি ঠাকুর ফিরিয়ে দেন সত্যজিৎকে। খাতা হাতে পেতেই আগ্রহ ভরে ছোট্ট সত্যজিৎ তা খুলে দেখতেই দেখতে পান সেখানে কোনও সই নয়, বরং রয়েছে আস্ত একটি কবিতা। সেখানে লেখা ছিল, বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে/বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে/দেখিতে গিয়াছি পর্বত মালা/ দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু। দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/একটি ধানের শীষের উপর/ একটি শিশির বিন্দু।
হ্যাঁ, ঠিক এখানেই শুরু হয় সত্যজিৎ এবং রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক, আর তৈরি হয় একটি ইতিহাস। কবিগুরুর সাহিত্য, জীবনবোধ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন সত্যজিৎ, যা আমরা দেখতে পাই সত্যজিতের চলচ্চিত্রে। সত্যজিতের ১৬ বছর বয়স যখন, তখন রবীন্দ্রনাথের অভিভাবকত্বে বড় হওয়ার জন্য সত্যজিৎকে ভর্তি করানো হয় শান্তিনিকেতনে। কবিগুরুর কাছে সযত্নে বড় হতে থাকেন ছোট্ট সত্যজিৎ।
রবীন্দ্রনাথের অভিভাবকত্বে যে সত্যজিৎকে প্রভাবিত করেছিল তা আমরা দেখতে পাই মানিকবাবুর একের পর এক সিনেমায়। একাধিক সিনেমায় রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসকে বেছে নেওয়া, সিনেমার জন্য রবীন্দ্রনাথের গান ব্যবহার করা এসবই ছিল কবিগুরুর প্রতি তার সম্মান।
১৯৪৫ সালে 'ঘরে বাইরে' উপন্যাসের চলচ্চিত্ররূপ লিখেছিলেন সত্যজিৎ কিন্তু অপটু হাতের জন্য তখন তা নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। এর প্রায় ৪০ বছর পর তিনি আবার নতুন করে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন। ১৯৮৪ সালে ভারতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং দামাস্কাস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার পায় এই সিনেমাটি।
তবে ১৯৬৪ সালে রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প কাহিনি উপলক্ষে মানিকবাবু তৈরি করেছিলেন ' চারুলতা ', যা বিশ্বের সিনেমার ইতিহাসে চিরকালের জন্য নিজের স্থান তৈরি করে নিয়েছিল। বলা হয়ে থাকে এই সিনেমাটি মানিকবাবুর হাতে তৈরি সব থেকে নিখুঁত একটি সিনেমা। এই ভাবেই সিনেমায়, গল্পে, গানে বারবার একাকার হয়ে যান মানিকবাবু এবং কবিগুরু।