শ্রীলেখা মিত্রএকজন মানুষের জীবনে একাধিক শিক্ষক থাকেন। আমারও আছে। আসলে আমি প্রত্যেকের কাছ থেকেই কিছু না কিছু শিখি। কিন্তু আমার জীবনে আদর্শ শিক্ষক কারা যদি জানতে চাওয়া হয়, তবে চার জনের কথা বলব— আমার মা, বাবা, পরিচালক আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত এবং আমার করণ।
প্রথমে আসি মায়ের কথায়। ছোট থেকেই দেখেছি মা খুব শান্ত স্বভাবের। একেবারে নির্বিবাদী মানুষ। মা এতই নিরীহ ছিলেন যে মাঝেমাঝে রাগ হত! মনে হত, মানুষটা কি কখনওই নিজের জন্য আওয়াজ তুলবে না? তবে যত বয়স বেড়েছে, মাকে বুঝতে শিখেছি। আমার শান্ত মায়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ধৈর্যের পাহাড়টাকে দেখতে পেয়েছি। জীবনের প্রত্যেকটি ধাপে ধৈর্য কতটা জরুরি, তা মা-ই আমাকে বুঝিয়েছেন।
মায়ের কাছ থেকে ধৈর্যের পাঠ নিলেও আমি কিন্তু আমার বাবার মতো। ওই মানুষটাকে দেখেই প্রথম জেগে উঠেছে আমার প্রতিবাদী সত্তা। আমার বাবা ছিলেন লড়াকু প্রকৃতির। মুখ বুজে অন্যায় সহ্য করেননি কখনও। প্রতিবাদ করেছেন। লড়েছেন কঠিন লড়াই। বাবা নাগরিক কমিটি করতেন। বহু মদের ঠেক বন্ধ করেছেন। পাড়ার যে সব ছেলেরা অল্প বয়সে বিপথে চলে গিয়েছিল, তাদেরও শাসন করেছেন বাবা। পড়াশোনা করে সুন্দর একটা জীবন গড়ে তোলার আগ্রহ জুগিয়েছেন তাদের। অন্যায়ের সঙ্গে আপোস করার মানসিকতা বাবার ছিল না। তাঁর সেই শিক্ষাকে আঁকড়েই বেঁচে আছি। যত দিন বাঁচব, মাথা উঁচু করে বাঁচব। গলা উঁচিয়ে ঠিককে ঠিক আর ভুলকে ভুল বলব। কারণ যে মানুষটি আমায় গড়েছেন, তিনি শিরদাঁড়া সোজা রাখার শিক্ষা দিয়েছেন আমায়।
আমার পেশাগত জীবনে একজন অবদানের কথা না বললেই নয়। আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত। আদিত্য আমার সহকর্মী। ওর পরিচালনায় ছবি করেছি। আর ওর সঙ্গে কাজ করতে গিয়েই যে কত কিছু শিখলাম! আমি মনে করি, পরিচালক হিসেবে আমার জন্ম হয়েছে সবে। ইন্ডাস্ট্রিতে তিন দশক কাটিয়েছি। এত বছর ধরে অভিনেত্রী হিসেবে মন দিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছি। আর আদিত্যর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বুঝেছি একজন পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া উচিত। ওর বাস্তববাদী ভাবনা, খুব সূক্ষ্ণ ভাবে একটি দৃশ্যকে দেখা, সেটিকে বোঝা— এ সবই আমাকে মুগ্ধ করেছে। আসলে আমি এ রকমই একজন শিল্পীকে খুঁজছিলাম! আমার ছবি দেখার তৃতীয় নয়নটা আদিত্য খুলে দিয়েছে। পরিচালক হিসেবে যা আমাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
এ বার আসি আমার করণের কথায়। ও আমার চারপেয়ে সন্তান। লকডাউনের সময় আমার ফ্ল্যাটের নীচে জন্মেছিল ও। রোজ যখন ওদের খেতে দিতে যেতাম, দেখতাম সবার শেষে আসছে করণ। ও এতটাই দুর্বল ছিল যে, বাকিদের সঙ্গে দৌড়ে পেরে উঠত না। গুটি গুটি পায়ে আসত সবার শেষে । কিন্তু গলার জোরে ঠিক নিজের ভাগের খাবারটুকু আদায় করে নিত। অতটুকু বয়সেই টিকে থাকার লড়াই লড়তে শিখেছিল ও। দুর্বল বলে দমে যায়নি। বরং নিজের সব শক্তি দিয়ে লড়ে গিয়েছে। এখন ও আমার কাছেই থাকে। ওকে ওষুধ খাওয়াতে আমায় এক প্রকার যুদ্ধ করতে হয়! স্নেহের অদৃশ্য এক সুতোয় বাঁধা পড়ে গিয়েছি আমরা। কে বলে একটা চারপেয়ে বাচ্চার থেকে কিছু শেখা যায় না? শুধু চোখ-কান একটু খোলা রাখতে হয়। জীবনে সবার কাছ থেকেই কিছু না কিছু শিখেছি। আবার জীবনও অনেক কিছু শেখায়। তাই সবার জন্যই বরাদ্দ থাকুক শিক্ষক দিবসের শুভেচ্ছা।