রণবীর ভট্টাচার্য
ফরিদা হোসেন নামটি এপার বাংলা হোক কিংবা ওপার বাংলা, দুই বাংলার মানুষই চেনেন। লেখক, কবি, নাট্যকার, সুরকার— শুরু করলে যেন শেষ হতে চায় না। ইদের কেনা কাটার পূর্বে উনি আমাদের সঙ্গে স্মৃতির মণিকোঠায় থাকা অনেক কিছু বললেন, আলোচনা করলেন অনেক কিছু। সেই কথোপকথনের কিছু অংশ তুলে ধরা হল।
এক টুকরো মেয়েবেলার স্মৃতি…
আমার জন্ম কলকাতায়। আমার বাবা ছিলেন হাইকোর্টের একজন আইনজ্ঞ।পরবর্তীকালে আমার বাবা ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের (ILO)-র গভর্নিং বডির মেম্বার হয়েছিলেন একেধারে ১৫ বছর।
যাই হোক, এরপর সাল ১৯৪৮, ভারতীয় উপমহাদেশের রক্তাক্ত দেশভাগ আর জীবনের প্রথম দুই বছর কলকাতায় কাটিয়ে আমার চট্টগ্রামে দাদুর বাড়ি চলে আসা হয়। ছয় ভাই বোন নিয়ে আমরা চলে আসি নারায়ণগঞ্জে। সেই দিনগুলো স্বপ্নের মতো ছিল। আমরা একমাত্র মুসলিম পরিবার, চারিদিকে হিন্দু পরিবার— কী অপূর্ব শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল আমাদের। আমি অবশ্য পড়াশোনায় কোনও কালেই খুব ভালো ছিলাম না।
প্রথম লেখার স্মৃতি…
গড়পড়তা মানুষ যেভাবে শখের লেখা দিয়ে শুরু করেন, আমার বোধহয় সেরকম করে এগোনো হয়নি। আমি চিরকালই প্রকৃতিপ্রেমী। নারায়ণগঞ্জের সেই দিনগুলির কথা এখনও মনে আসে। আকাশ, বাতাস, গাছ, পাখি— সব কিছুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠতাম আমি। আমি আবার খুব একটা খেলাধুলোর মধ্যে ছিলাম না। সবাই চিন্তিত হত যে আমি লম্বা হব তো! আমার অবসর সময়ে রকমারি চিন্তাভাবনা আমায় ঘিরে ধরত। আকাশ জুড়ে পূর্ণিমার চাঁদ দেখে মন আকুল ব্যাকুল করে উঠত। চাঁদের একাকিত্ব দেখে মন খারাপ হয়ে যেত। হয়তো এই ভাবেই জীবনে প্রকৃতি নিয়ে আত্ম উপলব্ধির জায়গা তৈরি হয়েছিল। অল্প স্বল্প লেখা শুরু হলেও সেটা নিজের জন্য। তাই হয়তো নিজের প্রথম গল্পের নাম রেখেছিলাম ‘ফুচকা’। তবে ভুললে চলবে না যে ১৯৫২-র সেই ভাষা আন্দোলনে আমার মামাকে হারিয়েছিলাম, যার রেশ থেকে গিয়েছিল অনেক দিন।
নিজেকে সৃষ্টিশীলতায় মেলে ধরা…
৫২-র ভাষা আন্দোলন আমার শিশু হাতে কলম তুলে দিয়েছিল। সেই সময় আমার ছাত্রনেতা মামা আন্দোলনে শহীদ হয়েছিলেন এবং আমাকে অনেক কিছু বুঝতে শিখিয়ে গিয়েছিলেন। আমাকে অনেকেই বলেন প্রতিভাধর। সবার মতামতকে সম্মান করেই বলছি, সবটাই যে ভীষণ ভাবনাচিন্তা করে করা এমনটাও নয়। সুযোগ এসেছে, নিজেকে মেলে ধরেছি, আর তার পিছু পিছু সম্মান এসেছে, জনপ্রিয়তাও। আমাদের বাড়িতে বাঙালি সংস্কৃতির চল ছিল। তাই কম বয়সেই আমি তালিম নিই উস্তাদের কাছে। লিখতে ভালোবাসতাম আর তার সঙ্গে গান লেখা আর গান সুর দেওয়াও শুরু হয়ে যায় কীভাবে যেন! বিভিন্ন রাগ ঘরানার গানের প্রতি আমার এখনও দুর্বলতা রয়েছে। পরবর্তীকালে সমাজচেতনা, আদর্শ, দেশ আমাকে প্রভাবিত করেছে। আর বলাই বাহুল্য, আমার স্বামী অধুনা প্রয়াত মোহাম্মদ মোশারফ হোসেনের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তিনি যেভাবে আমার পাশে থেকেছেন, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন জীবনের কঠিন সময়ে, আশার আলো দেখিয়েছেন, কোন প্রশংসাই যেন যথেষ্ট নয়। শিশু ও মহিলা কেন্দ্রিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছি আবার টিভির বিভিন্ন অনুষ্ঠান নির্দেশনা করেছি।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি…
আমরা ঢাকায় থাকি তখন। মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে অবশ্যই খবর রাখতাম আর আমার স্বামী রাজনীতির আঙিনায় ভীষণ জনপ্রিয় হওয়ার কারণে সমস্ত কিছু নিয়েই ওয়াকিবহাল ছিলাম। তবে স্বাধীনতার দুই দিন আগের কথা ভাবলে আজও মন কেমন করে ওঠে। পাক সেনারা হঠাৎই বাড়িতে আসে, আমার স্বামীকে ডেকে নিয়ে যায়। ব্যাপারটা আমি ঠাহর করার আগেই যেন ঘটে যায়। তখন বাসায় আমার দু’টি বাচ্চা। প্রতিবেশীরা বাড়ি এসে চলে যেতে বলে। সৌভাগ্যক্রমে আমি একজনের মাধ্যমে বাচ্চাদের মায়ের বাড়ি পাঠিয়ে দিই। আমি ঘরে খাটের কোনায় বসে অনবরত আল্লাহর সঙ্গে কথা বলে গিয়েছি যেন কেন তিনি এমন করলেন। বললে অবাক হবেন, পরের দিন সকালেই দেখি আমার স্বামী বাসায় ফিরে এসেছেন, সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায়। অনেকে ভাবতেই পারেননি যে শত্রুর ঘর থেকে উনি ফিরলেন কীভাবে, যেভাবে অনেকে আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন উনি আদৌও ফিরতে পারবেন কি না।
জীবন থেকে পাওয়া…
কী পেয়েছি, কী পায়নি— এগুলো নিয়ে এক সময়ে ভাবলেও একটা সময়ের পর থেকে আর ভাবিনি। ১৯৯০ সালে আমি মেম্বার হই পেনের। এরপর ২০০৩ সালে যখন বাংলাদেশ পেনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্ত হই, গুরুদায়িত্ব চলে আসে আমার উপর। এরপর দেশে বিদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের গিয়েছিল। বিভিন্ন দেশের নোবেল পুরস্কার বিজেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সৌভাগ্য হয়েছে। অবশ্যই আমি এবং পরিবারের সকলে খুব গর্বিত হই যখন ‘একুশে পদক’-এর জন্য আমাকে মনোনীত করা হয়। মনে পড়ে একবার মেক্সিকোতে ফ্যাস্টিভালে আমার একটি শর্ট ফিল্ম প্রদর্শনীর পর যেভাবে সকল অভ্যাগত আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। কাজলীর কথা, শুভাশিস— কত লেখার কথা মনে পড়ে। সেভাবে সেরা কাজ তো আর বলা যায় না। অনেক পাঠকই আমার লেখার মধ্যে সমাজচেতনা, মানবিকতা খুঁজে পেয়েছেন। সেটি আমার পরম প্রাপ্তি।
নতুন প্রজন্মের লেখক লেখিকাদের জন্য…
আজকাল দেখি সবাই কিছু না কিছু লিখে ফেলছে। কিন্তু কেউ পড়ছে না। বই পড়ার অভ্যাস করতেই হবে। যে কোনও বিষয়ে লিখতে গেলে, সেই নিয়ে প্রস্তুতি দরকার আবার অভিজ্ঞতাও। কত বার এরকম হয়েছে, আমি কোথাও ঘুরতে গিয়ে গাড়ি থেকে নেমে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশেছি। আবার সেখান থেকেই রসদ পেয়েছি আমার পরের লেখার। আমি মনে প্রাণে মনে করি, যাঁরা লেখেন তাঁদের সৎ হওয়া খুব দরকার। দিনের শেষে মানুষ যখন কোনও লেখা পড়েন, তারা যেন ভুল না পড়েন। নিজেকে শিক্ষিত করার প্রয়াস আজীবন চালিয়ে যাওয়া উচিত বলেই আমি মনে করি।
কোনও আফসোস…
জীবন আমাকে অনেক দিয়েছে। আমার মেয়েরা আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। নাম, যশ, খ্যাতির দিক থেকে প্রত্যেকেই ব্যুৎপত্তি লাভ করেছে। তবে একটি ঘটনার কথা বলতে চাই। সেই বার সম্ভবত একটি রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের সময় আমি অনেক ভিড়ের মধ্যে এগিয়ে চলেছি অনেক মানুষের ভালোবাসা আর শুভেচ্ছার মধ্যে দিয়ে। সেই ভিড়ের মধ্যে হঠাৎই একটি মেয়ে আমাকে প্রশ্ন করে, ‘শুনেছি আপনি গল্প লেখেন। আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখবেন?’ নাহ! সত্যি আমি পারিনি সেই কিশোরীকে নিয়ে কোনও গল্প লিখতে। সাংসারিক ব্যস্ততা আমাকে ওর চিন্তা থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
(ফরিদা হোসেন বর্তমানে আত্মজীবনী লেখায় ব্যস্ত। দুই বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতি জগতে ফরিদা হোসেন সমান জনপ্রিয়। কয়েক বছর আগে একটি বাংলা টিভি চ্যানেলে তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন প্রয়াত লেখিকা সুচিত্রা ভট্টাচার্য। কলকাতা গোর্কী সদনে ফরিদা হোসেন রচিত ও পরিচালিত তিনটি শিশুতোষ শর্টফিল্ম দেখানো হয়। ফরিদা হোসেনের বেশ কয়েকটি ধারাবাহিক ও সাপ্তাহিক নাটক প্রচার হয়েছে কয়েকটি চ্যানেলে)