সম্প্রতি অসমের গুয়াহাটিতে গামছা নিয়ে বিরাট বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ‘বাংলা সাহিত্য সভা, অসম’ নামের একটি সংগঠনের অধিবেশনে অতিথিদের সম্মান জানাতে অসমিয়া ও বাংলার গামছা অর্ধেক অর্ধেক পরিমাণে কেটে জোড়া লাগানা হয়। তা নিয়ে সারা রাজ্যে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
আসামের অনেক অংশে, গত কয়েক দিনে, এই নিয়ে কিছু সংগঠন এবং ছাত্রছাত্রী গোষ্ঠী তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। বাংলা সাহিত্য সভার তরফে অতিথিদের সম্মান জানাতে এভাবে দুই ধরনের গামছা সেলাই করাটি অত্যন্ত নিন্দনীয় বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
ঘটনাটি কী ঘটেছিল?
এই নতুন বিতর্কিত গামছার অর্ধেক লাল এবং সাদা ফুলের অসমিয়া ফুলম গামছা। এবং বাকি অর্ধেক লাল এবং সাদা চেকারযুক্ত প্যাটার্ন গামছা, যা সাধারণত বাঙালিরা ব্যবহার করেন। অসমিয়া সম্প্রদায়ের গামছার ধরন বদলে মাঝখান থেকে কেটে অর্ধেক অংশ বাঙালিদের গামছায় যোগ করায় বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। যদিও বাংলা সাহিত্য সভা অসমিয়া গামছা মাঝ খান থেকে ছেঁড়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
প্রতিবাদ হচ্ছে কেন?
বাংলা সাহিত্য সভা ২৫ মার্চ থেকে শ্রী হিতেশ্বর সাইকিয়া ভবন, মালিগাঁও, গুয়াহাটিতে দু’দিনের সম্মেলনের আয়োজন করে। সেখানে অসমের শিক্ষামন্ত্রী রনোজ পেগু, অসম সাহিত্য সভার পদাধিকারীরা উপস্থিত ছিলেন। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পেগু-সহ সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকল অতিথিকে এই নতুন গামছা পরিয়ে সম্মানিত করা হয়। কিন্তু অসমিয়া জনগণের একটি অংশ তাদের ঐতিহ্যবাহী গামছার সঙ্গে এই ধরনের কাণ্ড করায় চরম ক্ষুব্ধ। এমন পরিস্থিতিতে অসমিয়া গামছার এই নতুন সৃষ্টির বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে এফআইআরও দায়ের করেছেন কয়েক জন।
কৃষক সংগ্রাম সমিতি, বীর লচিত সেনা-সহ অনেকেই বাংলা সাহিত্য সভার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেছে। এই বিষয়ে গুয়াহাটির চাঁদমারি থানায় বাংলা সাহিত্য সভার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন মানবাধিকার কর্মী হীরক জ্যোতি বোরা।
জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বোরা বলেন, ‘বাংলা সাহিত্য সভার ওই সম্মেলনে আসাম সরকারের মন্ত্রী-সহ অনেক বড় বড় লোক উপস্থিত ছিলেন এবং তাদের এমন একটি বস্ত্র দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছিল। এটি কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। অসমিয়া গামছাকে এভাবে মাঝখান থেকে কেটে অন্য গামছায় যোগ দেওয়া শুধু গামছার অপমানই নয়, আমাদের আত্মসম্মানের প্রতীকের প্রতি আঘাতও। এটি আদিবাসীদের অধিকার লঙ্ঘনেরও চেষ্টা।’
(আরও পড়ুন: মাছ খেয়েও এমন হতে পারে? স্বামী কোমায়, মৃত্যু স্ত্রীর)
ক্ষমা চেয়েও লাভ হয়নি
তবে এই বিতর্ক বাড়তে দেখে ক্ষমা চেয়ে লিখিত বিবৃতি দিয়েছে বাংলা সাহিত্য সভা। বাংলা সাহিত্য সভার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, দু’টি সম্প্রদায়ের (অসমিয়া-বাঙালি) মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে এবং ব্রহ্মপুত্র ও বরাক উপত্যকার মধ্যে মিলনের প্রতীক হিসেবে এই দুই বস্ত্রকে যুক্ত করে একটি তৈরি করা হয়েছিল। বর্তমানে বিভিন্ন থানায় দায়ের করা মামলায় বাংলা সাহিত্য সভার কোনও পদাধিকারীকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে কি না, তা এখনও জানা যায়নি।
মানবাধিকার কর্মী বোরা বলেন, বাংলা সাহিত্য সভা একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান, কিন্তু এই সংগঠন যেভাবে পরোক্ষভাবে ক্ষমা চেয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। তিনি বলেন, ‘বাংলা সাহিত্য সভাকে আইনি পদ্ধতিতে অসমের জনগণকে লিখিতভাবে নিশ্চিত করতে হবে যে, এমন ভুল আর হবে না।’
(আরও পড়ুন: ‘দুটো বিয়ে করব’, বিয়ের পরেই চিৎকার মহিলার! ভিডিয়ো দেখে হতবাক সবাই, কেন এই দাবি)
অসমিয়া গামছার ঐতিহ্য
অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন অর্থাৎ AASU-এর প্রধান উপদেষ্টা সমুজ্জল ভট্টাচার্য আসাম সরকারকে এই বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এএএসইউ নেতা ভট্টাচার্য এই ঘটনার বিরোধিতা করে বলেন, ‘এই বস্ত্রটি আমাদের আত্মসম্মান। এটি জিআই ট্যাগ পেয়েছে। তাই, এর মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। কেউ একে অপমান করতে পারবে না, সবাইকে আহ্বান জানানো হচ্ছে একে রক্ষা করার। অসম সরকারকে এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানাই।’
আসামের সংস্কৃতি ও পরিচয়ের প্রতীক অসমিয়া গামছা গত বছরের ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন (জিআই) ট্যাগ পেয়েছে। এই হাতে বোনা গামছাগুলি আয়তাকার কাপড় দিয়ে তৈরি এবং উভয় পাশে লাল পাড়ের সীমানা রয়েছে যা রাজ্যের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে। এই গামছা অসমিয়া জনগণের আত্মসম্মানের প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হয়।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
প্রবীণ সাংবাদিক বৈকুণ্ঠ নাথ গোস্বামী বিবিসিকেএই বিতর্কের বিষয়ে বলেছেন, ‘অসমে বসবাসকারী সমস্ত জাতি ও উপজাতির নিজস্ব পোশাক, সংস্কৃতি, গান রয়েছে, তাই প্রত্যেকেরই তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক জিনিস অনুযায়ী আচরণ করা উচিত।’
তিনি বলেন, কেউ যদি বাইরে থেকে দেশান্তরে নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে এখানে এসে তা অনুসরণ করে থাকেন, তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু বাংলা সাহিত্য সভা নামের সংগঠনটি দু’টি সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটিয়ে অন্যরকম পট তৈরি করেছে। এটা কোনও মূল্যেই এখানে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনও ধরনের সংঘর্ষ এড়াতে এ ধরনের কাজ করা উচিত নয়।
কেন এই গামছাকে ঐতিহ্যের প্রতীক বলে মনে করা হয়?
ধর্মীয়, সামাজিক বা সাংস্কৃতিকভাবে আসামে অসমিয়া গামছার গভীর প্রতীকী মূল্য রয়েছে। এটি পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং ঐক্যের প্রতীক হিসাবে উপহার দেওয়া হয়। এছাড়াও, আশির দশকের গোড়ার দিকে অসম আন্দোলন হোক বা রাজ্যে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক বিক্ষোভ, বিক্ষোভকারীরা এই বস্ত্রটিকে অসমিয়া পরিচয়ের প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন।
কী বলছে সাহিত্য সভা?
বাংলা সাহিত্য সভার যুগ্ম সম্পাদক সন্দীপন দত্ত পুরকায়স্থ পুরো বিতর্ক এবং সংগঠনের দেওয়া লিখিত ক্ষমার বিষয়ে বিবিসি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আসলে আমরা অসমিয়া ও বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের জন্য দুটি গামছা তৈরি করেছি। গামছা মাঝখান থেকে ছেঁড়া হয়নি। অসমের গামছার সঙ্গে বাঙালি গামছা যুক্ত করা হয়েছে। তারপরও জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে কারও অনুভূতিতে আঘাত লাগলে, আমরা লিখিতভাবে দুঃখপ্রকাশ করেছি। এমনটা আর কখনও হবে না।
এর পরে তিনি বলেন, ‘বাংলা সাহিত্য সভা মাত্র দুই বছর হল হয়েছে এবং আমরা একটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সংগঠন। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হল অসমিয়া ও বাঙালিদের একটি শক্তিশালী সমন্বয়ের প্রচার করা। সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজে ভালো কিছু সৃষ্টি করাই আমাদের উদ্দেশ্য।’
(আরো পড়ুন: কোনও পয়সা খরচ হবে না, নিমেষে দূর হবে বাথরুমের দুর্গন্ধ! রইল সেরা টোটকা)
কর্মসূচি চলাকালে কোনও প্রতিবাদ হয়নি
যে প্রোগ্রামে ব্যবহৃত বস্ত্র নিয়ে পুরো বিতর্ক, সেখানে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীর মা’ও যুক্ত ছিলেন, কিন্তু সেই সময় কেউ এর বিরোধিতা করেননি, বরং শিক্ষামন্ত্রী একটি অভিনন্দন বার্তাও টুইট করেছিলেন।
সন্দীপন দত্ত পুরকায়স্থর বক্তব্য, ‘সেই অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী থেকে শুরু করে অসম সাহিত্য সভার সভাপতি পর্যন্ত উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা উপস্থিত ছিলেন৷ এছাড়া মুখ্যমন্ত্রীর মা মৃণালিনী দেবী অসম সাহিত্য সভার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।’ সেই সময়ও ওই বস্ত্র নিয়ে আপত্তি কেউ জানাননি। আমরা দুঃখ প্রকাশ করেছি এবং পুলিশ এখনও এই বিষয়ে আমাদের কোনও কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। আমরা চাই, এই বিবাদ এখানেই শেষ হোক।’
রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পেগু অনুষ্ঠানে যোগদানের পর, একটি টুইট বার্তায় বাংলা সাহিত্য সভাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং বরাক এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মধ্যে সমন্বয় জোরদার করার অভিপ্রায়ে রাজ্যের বাংলাভাষী অসমিয়া জনগণের দ্বারা আয়োজিত অনুষ্ঠানের প্রশংসা করেছেন।
(এই খবরটি আপনি পড়তে পারেন HT App থেকেও। এবার HT App বাংলায়। HT App ডাউনলোড করার লিঙ্ক https://htipad.onelink.me/277p/p7me4aup)