শিল্পীর মৃত্যু হয় না। শিল্পী অতিজীবিত থাকেন। এই মাত্র খবর পেলাম, শিল্পী নারায়ণ দেবনাথ তাঁর পার্থিব শরীর ছেড়ে চলে গিয়েছেন। কিন্তু নারায়ণ দেবনাথ যাননি। তিনি থেকে যাবেন। যত দিন সাহিত্য শিল্প থাকবে, তত দিন তিনি থেকে যাবেন তাঁর সেই সব অনবদ্য সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে।
পঞ্চাশের দশক থেকে তাঁর হাত ধরে একে একে বাঁটুল দি গ্রেট, নন্টে-ফন্টে, হাঁদা-ভোঁদা বাঙালি পাঠকের সামনে এল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম সঞ্চারিত হল সেই সব সৃষ্টি। আমাদের প্রজন্মের মানুষও নারায়ণ দেবনাথের সেই সব কাজ দেখেছে অনেক পরে। আমরা আমাদের বাবা-মায়েদের থেকে প্রথমে জেনেছি নারায়ণবাবুর কাজের কথা, ওঁদের থেকেই আমাদের হাতে এসেছে বাঁটুল, নন্টে-ফন্টেরা। এবং একই ভাবে আমাদের হাত থেকে সেগুলি ছড়িয়ে পড়েছে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে।
এখন গ্রাফিক নভেল নিয়ে হইচই শুরু হয়েছে। অনেকেই দাবি করছেন, গ্রাফিক নভেলকে সাহিত্যের অঙ্গ হিসাবেই ধরতে হবে। এখনকার প্রজন্মের অনেকেই আন্তর্জাতিক গ্রাফিক নভেল, তার ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী। কিন্তু অনেকেরই অজানা,পঞ্চাশের দশকে নারায়ণ দেবনাথের হাত ধরেই বাংলা ভাষায় শুরু হয়ে গিয়েছিল গ্রাফিক নভেলের যাত্রা। তাঁর আগে বাংলায় তো বটেই, ভারতীয় সাহিত্যেও এমন গ্রাফিক স্ট্রিপের চল ছিল না। একপ্রকার নারায়ণ দেবনাথের হাত ধরেই সাহিত্যের এই বিশেষ শাখাটির দরজা খুলে গিয়েছিল এই দেশে।
আমাদের ছোটবেলাতেও টিনটিন, অ্যাসটেরিক্সের মতো বিদেশি গ্রাফিক নভেলের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি আমরা। কিন্তু সেগুলি এখানকার পাঠাকদের হাতে আসার অনেক আগেই নারায়ণ দেবনাথ বাংলা ভাষায় শুরু করে দিয়েছিলেন এই জাতীয় লম্বা গল্প ছবির মাধ্যমে বলার। গোয়েন্দা কৌশিক রায়ের উদাহরণ ধরা যাক। এমন অ্যাডভেঞ্চার গ্রাফিক নভেল বাংলায় তো বটেই, ভারতেও প্রথম। খুব সম্ভবত। খুব সম্ভবত কেন? ওঁর হাত ধরেই এসেছে। এটা জোর দিয়েই বলা যায়।
এছাড়া নারায়ণ দেবনাথের আর একটা গুরুত্ব না বললেই নয়। এখন আমরা দেখি, গ্রাফিক নভেল মূলত শহুরে পাঠকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। নারায়ণবাবু এই সীমরেখাটা অতিক্রম করে গিয়েছিলেন। গ্রামের শিশুদের হাতেও পৌঁছে গিয়েছিল বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদারা।
একটা শিল্পকে কখন কালোত্তীর্ণ বলা যায়? যখন সেই শিল্প আট থেকে আশি— সকলের ভালো লাগবে, সকলকে আনন্দ দেবে, সবচেয়ে বড় কথা সকলকে ভাবাবে। নারায়ণ দেবনাথের কাজও তেমনই— সকলের জন্য, সব বয়সের জন্য। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি, ছোটবেলায় আমরা যতটা আনন্দ পেতাম, এখনও ঠিক ততটাই আনন্দ পাই। বইয়ের সে সব পাতা ওল্টালেই নিজের ছোটবেলাই যেন চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টে শুধু আর কার্টুনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, ওর মধ্যে নিজেকেই খুঁজে পাওয়া যায়। সেই কারণেই নারায়ণ দেবনাথের কাজ কালোত্তীর্ণ।
নারায়ণবাবু এক সময়ে প্রচুর ইলাস্ট্রেশনের কাজ করতেন, প্রচুর প্রচ্ছদ আঁকতেন। কিন্তু পরে তা বন্ধ করে দেন। পুরোপুরি মন দেন কার্টুনে। জীবন পুরোটাই উৎসর্গ করেন এই শিল্পের চর্চায়। আর এ কারণেই তাঁকে ইতিহাস মনে রাখবে।
(লেখক পেশায় কার্টুনিস্ট, কার্টুনের ইতিহাস চর্চাকারী)