রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চেনা বাবার হাত ধরেই। হাফ প্যান্ট পরে হারমোনিয়াম কোলে নিয়ে বাবার সঙ্গে পাড়ায় পাড়ায় রবীন্দ্রজয়ন্তীতে গান গাইতে যাওয়া সেই ছোট্ট ছেলেটা এখন স্বনামধন্য সঙ্গীত শিল্পী মনোময় ভট্টাচার্য। ছোটোবেলায় বাবার কাছেই প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের হাতেখড়ি, তখন রবীন্দ্রচেতনা তত প্রবল ছিল না, কিন্তু এখন রবীন্দ্রনাথ মনোময়ের দিন শেষের শান্তির আশ্রয়। আজ গায়কের কাছে রবীন্দ্রজয়ন্তী মানে একরাশ ব্যস্ততা, কিন্তু ছোটবেলায় কেমন কাটত রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিনগুলি? একান্ত সাক্ষাৎকারে হিন্দুস্তান টাইমস বাংলাকে জানালেন মনোময় ভট্টাচার্য।
আজ তো ভীষণ ব্যস্ত, কিন্তু ছোটবেলায় কীভাবে কাটত রবীন্দ্রজয়ন্তী?
মনোময়: রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিনটা আমারা সব ভাই-বোনরা মিলে ঘরোয়া ভাবে উদযাপন করতাম। বাড়িতেই বসত গানের আসর। দিদি, মা আর আমি গান করতাম, আর আমাদের তবলায় সঙ্গত করতেন দাদা। তবে শুধু বাড়িতেই নয়, বাবার হাত ধরে বেশ কয়েকটি পাড়ায় রবীন্দ্রজয়ন্তীতে গান গাইতে যেতাম। তখন অনেক ছোট আমি, হাফপ্যান্ট পরতাম। রিক্সায় করে বাবা আমাকে নিয়ে যেতেন, কোলে থাকত হারমোনিয়াম। আমার কাছে রবীন্দ্রজয়ন্তী মানেই বাবা। আসলে আমার রবীন্দ্রসঙ্গীতের হাতেখড়ি বাবার কাছেই।
আরও পড়ুন: জানলে অবাক হবেন, রবীন্দ্রনাথের বংশের আসল পদবী ‘ঠাকুর’ নয়! তবে কী ছিল
তাহলে রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে নিশ্চয়ই বাবার অনেক স্মৃতি...
মনোময়: হ্যাঁ, বাবা আমাকে হাতে ধরে ধরে নোটেশন দিয়ে গান শেখাতেন। বাবা তো ৮১ বছর বয়সে চলে যান, তার আগে অর্থাৎ ২০১১ সাল পর্যন্ত আমার যেসমস্ত রবীন্দ্রসঙ্গীতের অ্যালবাম মুক্তি পেয়েছে তাঁর সবটাই বাবার শেখানো গান। এমনকি এখনও আমি যে সমস্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত গাই তা সবই ওঁর শেখানো। বাবা চলে যাওয়ার কিছুদিন আগের সেই দিনটার কথা আমার এখনও মনে আছে, বাবা তখন খুব অসুস্থ, আমি রবীন্দ্রনাথের একটা গান তুলতে গিয়ে একটা ভুল করি। বাবা সেই অসুস্থ অবস্থায় ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে বলেছেন, "এই জায়গাটা ভুল হচ্ছে, একটু দেখে নে তো" তারপর তিনি নিজে আমাকে হাত দিয়ে নোটেশন দেখালেন। বাবা আমাকে আট-নয় বছর বয়স থেকেই এমন করে গান শেখাতেন। তখন আমি নজরুলগীতি গাইতেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতাম, আর বাবা আমাকে একপ্রকার জোর করেই রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাতেন। তখন অত বুঝতাম না, যদিও রবীন্দ্রনাথকে বোঝার মতো বয়স তখন ছিল না। কিন্তু যত বড় হতে থাকলাম, তত বুঝলাম রবীন্দ্রসঙ্গীতের মানে। রবি ঠাকুর তাঁর গানের ভাষা আর সুর নিয়ে আমার কাছে আরও বেশি করে জীবন্ত হয়ে উঠলেন। বাবা ছোটবেলায় জোর না করলে হয়তো এমনটা হত না। উনিই আমার মধ্যে রবীন্দ্রচেতনার সঞ্চার করেছিলেন।
আরও পড়ুন: বিধ্বংসী রূপে শাকিব, অন্য মেজাজে ধরা দিলেন চঞ্চল, প্রকাশ্যে ‘তুফান’-এর টিজার
আপনার ছেলেও তো খুব সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়, আপনিও কি বাবার মতো করেই ওর মধ্যে রবীন্দ্রচেতনার সঞ্চার করেছেন?
মনোময়: সত্যি বলতে, ওর মধ্যে রবীন্দ্রচেতনা সেই অর্থে এখনও আমি তৈরি করতে পারিনি। তবে আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলে ও তা উপভোগ করে। অ্যারেঞ্জমেন্ট ভালো লাগলে সেটাও জানায় আমাকে। আকাশ 'আমারও পরানও যাহা চায়' গেয়েছে, কিন্তু সেটা একেবারেই ওর মতো করে। আমি যেভাবে বাবার কাছে শিখেছি, সেইটার প্রতি ওর আকর্ষণ একটু কম। আসলে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কানটা বদলে গিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইন্টারনেটের দৌলতে গ্লোবাল মিউজিক এখন ওদের হাতের মঠোয়। ওরা ওয়েস্টার্ন মিউজিক বেশি শোনে। তাই গানকে গ্রহণ করার বা গাওয়ার ধরণের মধ্যেও একটা পরিবর্তন দেখা যায়।
তাহলে নতুন প্রজন্মকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাতে গেলে কি আধুনিক গানের মতো করে শোনাতে হবে?
মনোময়: কিছুটা তাই, এখন একেবারে রাবীন্দ্রিক ধাঁচে এসরাজ বাজিয়ে গান করলে হয়তো তারা শুনবে না, তবে একেবারে ভেঙ্গে, বাইরে থেকে কতকগুলো শব্দ নতুন করে যোগ করে শোনানোরও প্রয়োজন নেই। এই ক্ষেত্রে আমরা গানের অর্থ বুঝে যন্ত্রানুসঙ্গের ব্যবহারে কিছু বদল আনতে পারি। যেভাবে কথা বলি সেই সহজাতভাবেই গানটা গাইতে পারি, কিন্তু সেটা অবশ্যই নোটেশনকে মাথায় রেখে। 'উলালা' করে নয়।
'উলালা' করেও তো রবীন্দ্রসঙ্গীত অনেকে করছেন, শ্রোতারা পছন্দও করছেন সেই গান...
মনোময়: তা তো হচ্ছেই, তবে আমি এই ব্যাপারে একটু গোঁড়া। এই বিষয়গুলো আমার একদমই পছন্দ নয়, এভাবে কখনই রবীন্দ্রসঙ্গীত হতে পারে না। এটা আমার কাছে এটা গ্রহণযোগ্য নয়। নিশ্চয়ই মর্ডাণ করে রবি ঠাকুরের গান গাওয়া যাবে কিন্তু কখনওই তা মাত্রা ছাড়িয়ে নয়, সমস্ত কিছুর একটা মাত্রা থাকা উচিত। আর সেটাও কিন্তু নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের বোঝাতে হবে। তাঁদের মধ্যে রবীন্দ্রচেতনার সঞ্চার করতে হবে। আর এটা শুরু করতে হবে বাড়ি থেকেই। বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের গান শোনাতে হবে, তাঁর লেখা, কবিতা ইত্যাদি পড়াতে হবে। তবেই তো পরের জেনারেশন জানবে যে রবীন্দ্রনাথ কী করে গিয়েছেন, পাশাপাশি তাঁরা মাত্রাটাও বুঝতে শিখবে।
হ্যাঁ, তবে রবীন্দ্রচর্চাতো প্রায় প্রত্যেকটা বাঙালি বাড়িতেই হয়ে থাকে, এমনকী তাঁকে ঘিরে যে উদযাপন তা অন্য কোনও কবি সাহিত্যিকে নিয়ে এতটাও দেখা যায় না...
মনোময়: আসলে রবি ঠাকুর আমাদের 'মনের মানুষ'। আমাদের জীবনের সমস্ত আবেগ অনুভূতিগুলোকে নিয়ে তিনি লিখে গিয়েছেন। আর আমাকে সবচেয়ে বেশি যেটা অবাক করে তা হল ওঁর গানের ভাষা। উনি যে ধরণের শব্দচয়ন করেছেন তা খুব সহজেই মানুষের মনকে স্পর্শ করে। আমি নিজে নজরুল ইসলামের গান গাইতে খুব পছন্দ করি, নজরুলগীতি রাগ ভিত্তিক। যার ফলে যিনি গাইছেন শুধু তিনি নিন, যিনি শ্রোতা তাকেও রাগ ভিত্তিক গান সম্বন্ধে জানতে হবে। না হলে তিনি নজরুলের গানের সম্পূর্ণ রস আস্বাদন করতে পারবেন না। কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত সেই জায়গা থেকে অনেক সহজাত। তাই তাঁকে নিয়ে এতটা উদযাপন। তবে রবীন্দ্রনাথের এমন অনেক গান রয়েছে যেগুলো নিয়ে খুব বেশি চর্চা হয় না।
আপনাকে তো সব ধরনের রবীন্দ্রসঙ্গীতই গাইতে শোনা যায়, আপনার পছন্দের কোন আঙ্গিকের গান?
মনোময়: রূপক অঙ্গের গান গাইতে বেশি ভালোবাসি। আসলে আমি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা নিয়মিত করি, তাই ওই গানগুলো আমাকে বেশি টানে। রবীন্দ্রসঙ্গীত আর রবি ঠাকুর আমার অনেকটা জুড়ে রয়েছেন।
আপনার জীবনের রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা ঠিক কী?
মনোময়: রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে শান্তির আশ্রয়। সারাদিনের সমস্ত কাজ, জীবনের আক্ষেপ, না পাওয়ার যন্ত্রনা, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের দর্শকদের মুখোমুখি হওয়ার পর যখন গাড়িতে উঠি, তখন রবি ঠাকুরের গান প্রশান্তি নিয়ে আসে।
আজ সারাদিন কীভাবে কাটবে?
মনোময়: আজ তো সারাদিন নানা কাজে ব্যস্ত থাকব। তবে একটা সময় বের করে আমি আজও বসার চেষ্টা করি সেই ছোটবেলার দিনগুলোর মতো। এখন বাড়ির সকলের সঙ্গে বসা হয় না ঠিকই। তবে, আমার কিছু ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে সন্ধ্যেবেলা আমরা একেবারেই ঘরোয়া ভাবে একটু গান বাজনা করি। সেখানে যে সমস্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত সারা বছর চর্চা হয়, সেগুলোকেই আরও একবার সবাই মিলে একসঙ্গে গাই।