বছর পঞ্চাশেক আগে বাঙালির ঘরে ঘরে বইয়ের তাকে জায়গা করে নিয়েছিল নারায়ণ সান্যালের লেখা ‘বিশ্বাসঘাতক’ বইটি। আমেরিকার ম্যানহাটন প্রোজেক্ট, তার সঙ্গে পরমাণু বোমা তৈরির ইতিহাস, তাবড় বৈজ্ঞানিকদের জোটবাঁধা, এবং কারও বিশ্বাসঘাতকতা। এই সব নিয়ে বেশিটা বাস্তব, কিঞ্চিৎ কল্পনার রঙে রাঙিয়ে নারায়ণবাবু লিখেছিলেন বাংলার সর্বকালের অন্যতম সেরা ‘পপুলার সায়েন্স’-ধর্মী উপন্যাস। এবং সেই উপন্যাসের সূত্রেই বাঙালির একাংশ পৌঁছে গেল লস আলামোসের কাছে, ম্যানহাটন প্রোজেক্টের অন্দরে অন্দরে। পরিচিত নামের তালিকায় উঠে এল রবার্ট ওপেনহাইমার, কর্নেশ প্যাশ, রিচার্ড ফাইনম্যান থেকে ম্যাকেঞ্জি কিংয়েরা। প্রায় সেই থেকেই এক প্রকার ম্যানহাটন প্রোজেক্ট বিশেষজ্ঞ বাঙালি জাতির একাংশ।
নারায়ণবাবুর উপন্যাসের নামকরণের ক্ষেত্রে যে এক শব্দের উপর ভরসা রেখেছিলেন, ক্রিস্টোফার নোলানও তাঁর এই সিনেমা তৈরির ক্ষেত্রে সেই শব্দকেই চালিকাশক্তি বানিয়েছেন। আর তার সূত্রেই ধীরে ধীরে বৃত্ত তৈরি করেছেন। ম্যানহাটন প্রোজেক্ট থেকে কী করে বেরিয়ে গেল পরমাণু বোমার ফর্মুলা? কী করে তা পৌঁছে গেল রাশিয়ার হাতে? কমিউনিস্ট কোনও বিজ্ঞানী দায়ী এ জন্য? নাকি অন্য কেউ? কে সেই বিশ্বাসঘাতক? এই রহস্যের উদঘাটনের চার পাশেই বলয়ের মতো তৈরি হয় ‘ওপেনহাইমার’-এর কাহিনি।
তবে বলয় একটি নয়, দু’টি। একটি হল বিশ্বাসঘাতক কে— তাকে খুঁজে দেখা, দোষারোপ, পালটা দোষারোপ, প্রশ্ন, উত্তর, রাজনীতির আবর্তে পাক খাওয়া একটি অংশ। আর তারও বাইরে দিয়ে ঘুরতে থাকে, একটি মানুষের সৃজনশীলতা, তার সৃষ্টিকর্ম, যে সৃষ্টিকর্ম এক সময়ে ডেকে আনবে বীভৎস এক ধ্বংসলীলা, তার পূর্বাভাস ইত্যাদি প্রভৃতির জালে জড়িয়ে পড়া একটি মানুষের মন। এভাবেই ‘ওপেনহাইমার’কে বানিয়েছেন ক্রিস্টোফার নোলান।
ছবিটি মুক্তির আগে থেকেই সবাই জানতেন, পরমাণু বোমার আবিষ্কার নিয়েই এই ছবি। কীভাবে রবার্ট ওপেনহাইমার আমেরিকার তাবড় বিজ্ঞানীদের সঙ্গে নিয়ে এই কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন, তা নিয়েই এর কাহিনি। কাই বার্ড এবং মার্টিন জে শেরউইনসের লেখা বায়োগ্রাফি ‘আমেরিকান প্রমিথিউস: দ্য ট্রায়াম্ফ অ্যান্ড ট্র্যাজেডি অব জে রাবর্ট ওপেনহাইমার’-এর কাহিনি থেকেই নোলান তৈরি করেছেন এই ছবি। ফলে সিনেমা হলে যাওয়ার আগে এই ধারণা, অনেকেরই ছিল, এখানে কী হতে চলেছে। কিন্তু সত্যিই কি তাই হল?
বিষয়টি তার চেয়ে কিছুটা আলাদা। নোলানের এই ছবি যতটা পরমাণু বোমার, তার চেয়ে অনেক বেশি করে মানুষে মুখের। তারা গাদা কথা বলে, তারা শোনে, তারা ভাবে, ভাবনার অতলে তলিয়ে যায়, ভালো-খারাপ খবরে মুখে আলো-আঁধারের জ্যামিতি খেলা করে, মুখে বিস্ফোরণ হয়। আর এটাই ‘ওপেনহাইমার’-এর ভরকেন্দ্র । ফলে এই ছবির সাফল্য বা তার দর্শনযোগ্যতার বিচার করতে বসলে সেই ভরকেন্দ্রের গুরুত্বকেই প্রাধান্য দিতে হবে।
যে ছবিতে সেই অর্থে কোনও বাহ্যিক যুদ্ধ নেই, লড়াই নেই, দৌড়োদৌড়ি নেই— যেখানে সব কিছুই মাথার মধ্যে, সংলাপের মধ্যে— সেখানে অভিনয় যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রবার্ট ওপেনহাইমারের চরিত্রে কিলিয়ান মার্ফি, লেউইস স্ট্রাউসের চরিত্রে রবার্ট ডাউনি জুনিয়র, লেসলি গ্রোভসের চরিত্রে ম্যাট ডেমন, কিটি ওপেনহাইমারের চরিত্রে এমিলি ব্লান্ট, এবং অবশ্যই হ্যারি ট্রুম্যানের চরিত্রে গ্যারি ওল্ডম্যান দুর্দান্ত। বিশেষ করে ওপেনহাইমারের চরিত্রে কিলিয়ান মার্ফি। তিনি হয়তো এখনও পর্যন্ত জীবনের সেরা অভিনয় করেছেন এই ছবিতেই। একই রকম ভাবে মারাত্মক ভালো রবার্ট ডাউনি জুনিয়কও। কিন্তু তার পরেও এই ছবি হয়তো ব্যক্তি বিশেষের ছবি হয়ে দাঁড়ায়নি। তাহলে?
এই ছবির ভরকেন্দ্র নির্মাণে ভূমিকা আছে আরও দু’জনের। প্রথম জন হয়েট ভান হয়েটমা। যিনি এই ছবির সিনেম্যাটোগ্রাফার। ৭০ মিলিমিটার আইম্যাক্স ফরম্যাটে বানানো এই ছবির ভিজ্যুয়াল আনন্দের পুরোটা নেওয়া সম্ভব নয় ‘আইম্যাক্স’ স্ক্রিন ছাড়া। এই ধরনের স্ক্রিন এই মুহূর্তে ভারতে বেশ কম। বা নেই-ই। এর আগে নোলানে ‘ডানকার্ক’ ছবিতে আইম্যাক্স ৬৫ মিলিমিটার ফিল্ম (প্যানাভিশন সিস্টেম ৬৫) ব্যবহার করেছিলেন তিনি। সেটি সেই সময়ের এক বিপ্লব। এবার ৭০ মিলিমিটারে হয়েটমা তাঁর ক্যারিশমা দেখিয়েছেন। এই ছবির ভরকেন্দ্র নির্মাণের আর এক কারিগর লুডউইগ গ্রোনানসন। তিনি এই ছবির আবহসঙ্গীত নির্মাতা। তাঁর কারণেই হয়তো গোটা সিনেমাটি চোখ বন্ধ করেও দেখা যেতে পারে। কোথাও কখনও সমস্যা হবে না।
১৯৯১ সালে অলিভার স্টোন জেএফকে হত্যার তদন্ত নিয়ে তৈরি করেন একটি সিনেমা। পলিটিক্যাল থ্রিলার ঘরানার অন্যতম সেরা সিনেমা হিসাবে সেটি এখনও পরিচিত নাম। ‘জেএফকে’ নামের সেই ছবি শুধু সিনেমা হিসাবেই বিখ্যাত নয়, একই ঘরাণার সিনেমার ব্যাকরণ নির্মাণের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় ধাপ। নোলানের ‘ওপেনহাইমার’ দেখতে দেখতে যে কারও মনে হতে পারে, কাহিনির টেনশন নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি কিছুটা হলেও ভরসা রেখেছেন ‘জেএফকে’র নির্মাণ শৈলীর উপর।
শেষে একটি কথা? বাঙালি দর্শকের কতটা ভালো লাগতে পারে এই ছবি? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বাঙালির আগ্রহ নেহাত কম নয়। সেই আগ্রহ নিয়ে এই ছবি দেখতে বসলে কিঞ্চিৎ হতাশ হতে হবে। ইতিহাসের চেয়ে বেশি করে, এই ছবি মানব মনের অন্দরের দিকের জানলা খুলে দিতে বেশি আগ্রহী। আর সেই কারণেই সংলাপ-ভারী এই ছবির দ্বিতীয়ার্ধ কিছুটা হলেও গতি হারায়। লক্ষাধিক মানুষের হত্যালীলার দায় শেষ মলাটে জায়গা পেলেও, শেষ পাতা পর্যন্ত চলতে থাকে মনের দ্বন্দ্ব, তার ওঠা-নামা। নিঃসন্দেহে পৃথিবীর কোনও না কোনও প্রান্তে ছবির শেষে নোলান হয়ে যান ‘বিশ্বাসঘাতক’। তা সে তাঁরা নারায়ণ সান্যালকে চিনুন বা না-চিনুন।