ছবি: দ্য আর্চিস
অভিনয়ে: সুহানা খান, খুশি কাপুর, অগস্ত্য নন্দা, বেদাং রায়না, যুবরাজ মেন্ডা, মিহির আহুজা
পরিচালনা: জোয়া আখতার
সম্প্রতি নেটফ্লিক্স ওটিটি মাধ্যমে মুক্তি পেয়েছে ‘দ্য আর্চিস’। দীর্ঘ দিন ধরেই এই ছবি নিয়ে জল্পনা চলছে। তার অন্যতম বড় কারণ— স্টারকিডস। শাহরুখ খানের কন্যা, অমিতাভ বচ্চনের নাতি, শ্রীদেবী-বনি কাপুরের কন্যা। তিন জনেরই প্রথম বড় ছবি। সঙ্গে পরিচালক জোয়া আখতার। ফলে প্রচার ছিল তুঙ্গে।
পাশাপাশি আরও একটা বিষয় আছে। সিনেমাটির নাম এবং চরিত্ররা। ‘দ্য আর্চিস’। চল্লিশের দশকের গোড়ার দিক থেকে আমেরিকায় প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল ‘আর্চি’ কমিকস। প্রধান চরিত্ররা হল আর্চি, বেটি, ভেরোনিকা, জাগহেড প্রমুখ। সেই চরিত্রদের নামগুলি নিয়েই ছবি বানিয়েছেন জোয়া। তবে গল্প নিঃসন্দেহে আমেরিকায় নেই। এসে পড়েছে ভারতে। ষাটের দশকে। উত্তর ভারতের পাহাড়ি ছোট্ট শহর রিভারডেল। ১৯১৪ সালে রিভারডেল সাহেব এই শহরটি তৈরি করেন। পরে এটি হয়ে ওঠে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের শহর। এর কেন্দ্রে একটি পার্ক। শহরের প্রতিটি শিশুর বয়স ৫ বছর হলেই, তাদের প্রত্যেকে একটি করে গাছ পোঁতে এই পার্কে। ফলে এই পার্কের সঙ্গে শহরের সকলের আবেগ জড়িয়ে রয়েছে। না, সকলের নয়, বেশির ভাগের।
আর এহেন পার্কটিকেই কেড়ে নিয়ে হোটেল বানাতে চায় এক ব্যবসায়ী। ভেরোনিকা লজের বাবা। আর্চি, ভেরোনিকা, রেগি, বেটি, জাগহেট এবং শহরের বাকিরা কি পারবে নিজেদের পার্ককে বাঁচাতে? নিশ্চয়ই পারবে। নাহলে এই ছবি বানানো হত না। মোটের উপর এই হচ্ছে ‘দ্য আর্চিস’ নামের মিউজিক্যালের গল্প। এবার আসা যাক মূল পয়েন্টে।
কেন দেখবেন এই ছবি? ৫টি কারণ প্রথমে রইল।
১। খুব সাধাসিধে ভাবেই এটি ‘মিষ্টি’ ছবি। রিভারডেল শহরের ছেলেমেয়েরা খুব হাসিখুশি। তারা সারা দিন গানবাজনা আনন্দ নিয়েই থাকে। শহরের লোকজনও এর চেয়ে খুব একটা আলাদা নয়। গোটা ছবিটা টানা দেখলে একটা উইকেন্ড সন্ধ্যা বেশ ফুরফুরে লাগতে পারে।
২। ছবির দৃশ্যায়ন চমৎকার। সেট অসাধারণ। সব কিছু ঝলমল করে। ষাটের দশকে নিয়ে এসে ফেলা হয়েছে গল্পকে। সময়ের মতো করে সেট বানানোর চেষ্টা করেছেন নির্মাতারা। সেখানে খামতি রাখেননি।
৩। এটি যাকে বলে ‘পারফেক্ট রেট্রো’। লিপ গ্রিজের কৌটো থেকে ব্লক প্রিন্টের ছাপাখানা— পরতে পরতে নস্টালজিয়া উসকে দেওয়ার মতো উপাদান। ফলে যাঁরা টাইমমেশিনে কিছুটা পিছিয়ে যেতে চান, তাঁদের জন্য এটি আদর্শ ছবি।
৪। একই সঙ্গে এটি গোটা পরিবারের উপভোগ করার মতো ক্রিসমাস মুভিও বটে। ছবির সঙ্গীত এই কনসেপ্টের যোগ্য সঙ্গত দেয়। মন ভালো করার মতো আবহসঙ্গীত এবং সুর দিয়েছেন শঙ্কর, এহসান, লয় এবং জিম সত্য। ষাটের দশকে যখন রক এন রোলের সুরে সারা পৃথিবী মজেছে, তখন টিনএজাররা কোন ধরনের গানবাজনা পছন্দ করতে পারে এবং নিজেরা কোন ধরনের গানবাজনা তৈরি করতে পারে, তার একটা স্পষ্ট আভাস দিয়েছেন সঙ্গীত পরিচালকরা।
৫। হালে বলিউডে বা ভারতের মূল ধারার বাণিজ্যিক ছবিতে বেশ একটা রাজনৈতিক সচেতনতা-সচেতনতা ভাব ধরার চেষ্টা চলছে। বাণিজ্যিক ছবিও এখন বাণিজ্যের জন্য ‘প্রতিষ্ঠান’-এর বিরোধিতা করছে। সেই ধারায় এই ছবিও পড়ে। এর আগে ‘গালি বয়’ ছবিতে জোয়া এভাবেই অন্য এক প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা বা তাকে ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন। এখানেও সেই চেষ্টা তিনি চালিয়ে গিয়েছেন। যাঁরা সেই বিষয়টি উপভোগ করেন, তাঁদের জন্য এই ছবি ভালো।
এবার আসা যাক, পরের কথায়। কেন এই ছবি না-দেখলেও চলবে? রইল তারও ৫ কারণ।
১। ছবিতে প্রধান চরিত্রদের অভিনয়। সুহানা খান, অগস্ত্য নন্দা থেকে খুশি কাপুর। প্রত্যেকেরই এটি প্রথম বড় ব্রেক। নিশ্চয়ই তাঁরা আরও অনেক দূর যাবেন। কিন্তু প্রথম ছবিতে তাঁরা দাগ কাটতে প্রায় ব্যর্থ। অগস্ত্য নন্দাকে দেখে ‘অভিষেক বচ্চন লাইট’, খুশি কাপুরকে দেখে ‘জাহ্নবী কাপুর লাইট’, বেদাং রায়নাকে দেখে ‘রণবীর সিং লাইট’ (কেন কে জানে) বলে মনে হয়। একমাত্র ব্যতিক্রম সুহানা। তাঁকে দেখে অন্য কারও মতো লাগে না। কিন্তু ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বড় বেশি এক রকম লাগে। সেই এক চোখ বড়বড় করে হাসি আর নিষ্পাপ মুখে তাকিয়ে থাকা। প্রায় এই দু’টি অভিব্যক্তির মধ্যেই ঘোরাফেরা করেন তিনি। তবে এ জন্য তাঁদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আর সেখানেই আসে দ্বিতীয় পয়েন্টটি।
২। ছবিতে এই নবাগত-নবাগতারা হয়তো অনেক ভালো অভিনয়ই করতে পারতেন, যদি তাঁরা চিত্রনাট্যের সাহায্য পেতেন। চিত্রনাট্যে এই সিনেমার প্রধান চরিত্রগুলিকে বানানোই হয়েছে অতি সহজ-সরল ভাবে। যাকে বলে, ‘Too Basic’। ফলে প্রতিভা থাকলেও অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পক্ষে চরিত্রের খোলস ভেঙে বেশি কিছু করার সুযোগ নেই এই ছবিতে। তাই এক সময় গিয়ে তারা হয়ে যায় একঘেয়ে।
৩। ছবিতে একটি গান রয়েছে ‘Everything is Politics’। নতুন প্রজন্মের জন্য দারুণ মেসেজ। যখন শহরের প্রাণকেন্দ্র পুঁজিবাদীর হাতে চলে যাচ্ছে, তখন গল্পের প্রধান চরিত্র বলছে, এ সব নিয়ে সে মাথা ঘামায় না। কারণ তার রাজনীতিতে আগ্রহ নেই। তার সহপাঠীরা তাকে বোঝানোর জন্য গাইছে এই গান। ভালো কথা। কিন্তু এই একই বন্ধুরা আরও গোদা ভাবে দেখা যাওয়া সামাজিক এবং রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে নীরব। মেয়েদের জামার মাপ নিয়ে রক্ষণশীল মতামত থেকে পরিবারের ভিতরের পুরুষতান্ত্রিকতার মতো বিষয়গুলি তাদের উপেক্ষা এবং উপভোগের সীমারেখার মাঝখানের বাফার স্টেট দিয়ে নিরাপদে চলতে থাকে। যা কারও কারও ভালো নাই লাগতে পারে।
৪। ‘দ্য আর্চিস’ ছবির প্রধান চরিত্ররা সকলেই টিনএজার। সকলেরই চোখে স্বপ্ন, সকলেই কিছু না কিছু করতে চায়। কেউ বিদেশে গিয়ে কেরিয়ার তৈরি করতে চায়, তো কেউ শহরে থেকেই সংস্কৃতি আঁকড়ে সেটিকে নিয়ে এগোতে চায়। কেউ বা ‘কিচ্ছু চাইনি আমি আজীবন ভালোবাসা’ মোডে থেকে যেতে চায়। স্বপ্ন আলাদা, ভাবনা আলাদা— কিন্তু সবাই এক জায়গায় বিলকুল এক রকম। সবাই বোকা। এতটাই বোকা যে সকলকে একরম ‘মিষ্টি’ লাগে। আমার প্রেমিক, আমার প্রিয় বান্ধবীরও প্রেমিক— জানার পরেও বোকামির আবরণ ভেঙে কেউ রাগে না। কারণ রাগলে তাদের আর মিষ্টি লাগবে না। তারা কাঁদে। কারণ কাঁদলে আরও মিষ্টি লাগে। হতে পারে ষাটের দশকের কাহিনি। কিন্তু তখন কি টিনএজাররা সত্যিই এত বোকা, এত মিষ্টি এবং এত আত্মকেন্দ্রিক ছিল? টিনএজারদের হরমোনের ওঠানামা কি চাঁদে মানুষের পা রাখার পর থেকে শুরু হয়? এই ছবির চরিত্ররাও শেষ প্রশ্নটির মতোই। বোকা এবং মিষ্টি।
৫। এক হিসাবে এটি ‘অ্যান্টি-এসট্যাবলিশমেন্ট ফিল্ম’। হ্যাঁ, প্রতিষ্ঠান বিরোধী ছবি। পুঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে যেখানে যুব সম্প্রদায় গর্জে ওঠে। ছবির খলনায়ক সেখানে ছবির অন্যতম প্রোটাগনিস্টের বাবা (ঠিক যেন আশি বা নব্বইয়ের দশকের বলিউড-টলিউডের ছবি)। গল্পের শেষে দেখা যায়, ওই পাজি বাবাই মেয়ের কাণ্ডে খুশি! কেন? মেয়ে নাকি তার মতো হয়েছে। যে প্রকৃতি, যে গাছ, যে সবুজকে বাঁচানোর জন্য এই লড়াই— শেষ পাতে ‘মানবিক সম্পর্কের টানাপোড়েন’-এর ইতিতে এসে সেটি আবেগের মৃদু চোখের জল আর নাকের জল রুমালে মোছার সঙ্গে সঙ্গে ছবির গা থেকে মুছে যায়। আর্ম চেয়ার অ্যাকটিভিজিমের শেষ হয়। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার শেষ হয়। আকাশে অলক্ষ্যে রামধনু রং ওঠে। দেখতে চান? এসব ভালো লাগলে দেখতেই পারেন।
শেষ কথা— এই ছবি কি দেখা উচিত? মাস গেলে টাকা তো খরচ করেন! নেটফ্লিক্সের সাবস্ক্রিপশনের জন্য। হাতে কিছুটা সময় আছে? তাহলে দেখবেন না কেন? আর যদি সময় কিছুটা কম থাকে? বা আপনি যদি অধৈর্য্য দর্শক হন? নেটফ্লিক্স কিন্তু তলার দিকে একটি বোতাম রেখেছে। ছবির স্পিড বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য!