মঙ্গলবার কংগ্রেস নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে "বেসরকারিকরণের প্ররোচনা' দেওয়ার অভিযোগ তোলে। ‘ব্যাঙ্ক বিক্রি বিল’-এর বিরোধিতা করা হবে, সাফ জানিয়ে দিয়েছে কংগ্রেস।
কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলেন, পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কগুলিকে অবশ্যই প্রতিযোগিতায় এঁটে ওঠার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। কিন্তু তা না করে বেছে বেছে কয়েকজনের কাছে সেগুলি বিক্রি করলে, সেটা বিপর্যয় হিসাবে প্রমাণিত হবে।
এ বিষয়ে টুইটে তিনি বলেন, আজ থেকে ৫৩ বছর আগে ব্যাঙ্কগুলি জাতীয়করণ করা হয়েছিল। এখন, মোদী সরকার দ্রুত ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ করতে চাইছে।

১৯৬৯ সালের ১৯ জুলাই। দেশের ১৪টি প্রধান বেসরকারি ব্যাঙ্কের জাতীয়করণের সিদ্ধান্তের ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ইন্দিরা গান্ধীর এই পদক্ষেপ ভারতের অর্থনৈতিক চিত্রে আমূল বদল এনেছিল।
রাত সাড়ে ৮টায় ইন্দিরা গান্ধী তাঁর সিদ্ধান্তের ঘোষণা করেন। তিনি জানান, ব্যাঙ্কগুলির মোট আমানতের ৮৫% জাতীয়করণ করা হবে।
তালিকায় ছিল,
- সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া
- ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া
- পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক
- ব্যাঙ্ক অফ বরোদা
- দেনা ব্যাঙ্ক
- ইউকো ব্যাঙ্ক
- কানারা ব্যাঙ্ক
- ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক
- সিন্ডিকেট ব্যাঙ্ক
- ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া
- এলাহাবাদ ব্যাঙ্ক
- ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্ক
- ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্ক ওভারসিজ ব্যাঙ্ক
- ব্যাঙ্ক অফ মহারাষ্ট্র
কেন সরকারি করা হয়েছিল ব্যাঙ্কগুলি?
কৃষি, ক্ষুদ্র শিল্পে ব্যাঙ্কের অনুপস্থিতি: তত্কালীন সরকারের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, বড় বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি প্রাথমিকভাবে পুঁজিপতিদের স্বার্থে কাজ করছিল। কিন্তু দেশের বৃহত্তর স্বার্থকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ক্ষুদ্র ব্যবসা, কৃষি খাতে ব্যাঙ্কের প্রবেশ ছিল না বললেই চলে।
ব্যাঙ্কগুলির দৈন্য দশা: ব্যাঙ্কগুলির ব্যবসাও যে দুর্দান্ত ছিল, তা বলা যায় না। স্বাধীনতা-পরবর্তী বছরগুলিতে দেশজুড়ে ৩৫০ টি বেসরকারি ব্যাঙ্ক স্থাপন হয়েছিল। কিন্তু তার কোনওটাই টেকেনি।
আমজনতার আস্থা: এর ফলে আমানতকারীরা তাঁদের সর্বস্ব হারান। এমন উদাহরণ দেখে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার প্রতি আস্থাই উঠে গিয়েছিল সাধারণ মানুষের।

এমন পরিস্থিতিতে সরকারি নজরদারি ও শিলমোহরের মাধ্যমে ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রকে চাঙ্গা করার সিদ্ধান্ত নেন ইন্দিরা গান্ধী। আমজনতা যাতে সরকারের ঘরে টাকা রাখছেন ভেবে, নিশ্চিন্তে আমানত জমা বা ঋণ নিতে পারেন, সেটাই নিশ্চিত করা ছিল তাঁর লক্ষ্য।
সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ ছিল?
যদিও নিন্দুকের মতে, এটি একটি চরম 'সমাজতান্ত্রিক' সিদ্ধান্ত ছিল। ব্যাঙ্কের মতো লাভজনক সংস্থায় সরকারি নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকে।
সমালোচনার জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, 'আমাদের দেশে ব্যাঙ্কিংয়ের সুবিধা আরও ছড়িয়ে দিতে হবে। অনগ্রসর অঞ্চলে, কৃষি, ক্ষুদ্র শিল্প এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে এটি প্রসারিত করা উচিত। একটি বৃহত্তর সামাজিক উদ্দেশ্য দ্বারা ব্যাঙ্কিং কার্যক্রম চালনা করা উচিত। এটাকেই যদি কেউ রাজনৈতির দৃষ্টিভঙ্গি বলে ব্যাখ্যা করেন, তবে হ্যাঁ, অবশ্যই এটি একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি।'
অর্থমন্ত্রীকেও জানাননি ইন্দিরা
রিপোর্ট বলছে, এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেও, ইন্দিরা গান্ধী তাঁর সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী মোরাজি দেশাইয়ের মতামত নেননি। এটা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক কারণ, মোরারজী দেশাই এর আগে এমন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তাঁর দ্বিমত প্রকাশ করেছিলেন।
ইন্দিরা গান্ধী তাঁর সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর পরই তাঁকে চিঠি দিয়েছিলেন মোরারজী দেশাই। তাতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন তিনি।
চিঠিতে লিখেছিলেন, 'আপনি অর্থ মন্ত্রকের পরিবর্তন করতে চান। তার আগে তো আমার সঙ্গে এটি নিয়ে আলোচনা করতে পারতেন। কিন্তু এখন, আপনি আমার সঙ্গে এমন আচরণ করলেন, যেটা কেউ একজন কেরানির সঙ্গেও করবে না।'
কৃষিতে কতটা বেড়েছিল ব্যাঙ্কিং?
এই পদক্ষেপের পিছনে ইন্দিরার মূল উদ্দেশ্য ছিল গ্রামীণ খাতে ঋণ নিশ্চিত করা। কিন্তু, বাস্তবে সবকিছু সেই পরিকল্পনামাফিক হয়নি।
১৯৫১ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে, শিল্প খাতে ব্যাঙ্ক ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। অন্যদিকে, এই একই সময়ে, ব্যাঙ্কের মোট ঋণের মাত্র ২% গিয়েছিল কৃষি খাতে।
এমনটাও ভাবার কোনও কারণ নেই, যে সেই সময়ে ভারতে কৃষির উপযুক্ত পরিবেশ বা পরিকাঠামো ছিল না। সেই সময় ভারতে সবুজ বিপ্লব চলছিল। বিভিন্ন প্রযুক্তির প্রয়োগ করে কৃষিকে তার বর্তমান আধুনিক চেহারায় রূপান্তরিত করা হয়েছিল। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতেও এত কম ব্যাঙ্ক ঋণ সত্যিই অভাবনীয়।
সুপ্রিম কোর্ট
ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রীয়করণের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করা হয়েছিল। সেই মামলায় ১৯৭০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। তাতে সর্বোচ্চ আদালত জানায়, এটি বৈষম্যমূলক পদক্ষেপ ছিল। ৯,০০০ কোটি টাকার যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে, সেটা খুবই কম।
ইন্দিরা গান্ধী সুপ্রিম কোর্টের রায়কে অগ্রাহ্য করেন। এর চার দিন পরেই একটি নতুন অধ্যাদেশ প্রবর্তন করেন। সেটাই পরবর্তীকালে ১৯৭০ সালের ব্যাঙ্কিং কোম্পানি (অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ট্রান্সফার্স অফ আন্ডারটেকিংস) আইন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়।
ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের মাধ্যমে ইন্দিরা গান্ধী বিপুল জন সমর্থন পেয়ে যান। এটিই তাঁর ১৯৭১ সালের জাতীয় নির্বাচনে এবং ১৯৭২ সালের রাজ্য নির্বাচনে জয়ের অনুঘটক হিসাবে কাজ করে।
প্রাক্তন আরবিআই গভর্নর সি রঙ্গরাজন, এ বিষয়ে বলেছেন, '১৯৬৯ সালের জাতীয়করণ একটি বড় পদক্ষেপ ছিল। এটি ব্যাঙ্কিংয়ের ক্ষেত্র প্রসারিত করতে সহায়তা করেছিল। পরবর্তীতে ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকের ব্যাঙ্কিং সংস্কারগুলি একটি দক্ষ ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা তৈরি করতে সাহায্য করেছিল। ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ ব্যাঙ্কিংকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে, গ্রামীণ এলাকায় নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। অন্যদিকে ১৯৯১ সালের ব্যাঙ্কিং সংস্কারগুলি এটাকে স্থিতিশীলতা প্রদানে সহায়তা করে।'