সালটা ২০১২। মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষ দিনে পরীক্ষা দিয়ে প্রেমিকের হাত ধরে ঘর ছেড়েছিল এক কিশোরী। চোখে তখন অনেক স্বপ্ন। যা দেখিয়েছিল প্রেমিক। কিন্তু সেই স্বপ্নের নেপথ্যে যে নরক–যন্ত্রণা আছে সেটা বুঝতে পারেনি কিশোরী। বিশ্বাস করেই প্রেমিক রুহুল কুদ্দুস গাজির কথায় শিয়ালদাগামী ট্রেনে ওঠে বসিরহাটের বাসিন্দা ওই কিশোরী। কিছুদূর ট্রেন যাওয়ার পর ঠাণ্ডা পানীয়ের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাইয়ে দেওয়া হয় কিশোরীকে। তারপর অচৈতন্য হয়ে পড়লে প্রেমিক কুদ্দুস তাকে কলকাতার এক যৌনপল্লীতে বিক্রি করে দেয় বলে অভিযোগ। মাত্র ২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে ‘বিক্রি’ করে দেওয়া হয় ওই কিশোরীকে।
তারপর থেকে ক্রমাগত কিশোরীর চোখের রঙিন স্বপ্ন ফিকে হতে শুরু করে। সবটা বুঝতে পেরে যৌনপল্লী থেকে পালিয়ে নিজের গ্রামে ফিরে যায় কিশোরী। কিন্তু সেখানে কাত পাততে পারেনি নির্যাতিতা। কারণ কুদ্দুস এবং তার বন্ধু মহম্মদ ইসমাইল মণ্ডল গোটা গ্রামে কুৎসা রটিয়ে দেয় যে, ওই কিশোরী ‘যৌনকর্মী’ হয়ে গিয়েছে। প্রেমিকের আড়ালে যে এত বড় শয়তান বাস করছিল এবার তা টের পায় ওই কিশোরী। তখন নিজেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করলে মহম্মদ ইসমাইল মণ্ডল কিশোরীর উপর যৌন নির্যাতন করে বলে অভিযোগ। এই কঠিন পরিস্থিতিতে গ্রামের এক যুবকের কাছ থেকে বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে সংসার করতে যায় ওই কিশোরী। তবে সেখানেও তার নামে কুৎসা ছড়ানোয় বিয়ের দুদিনের মধ্যেই শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হয় বলে অভিযোগ।
তারপর ঠিক কী ঘটল? এরপর কিশোরীর জীবন যেন নিঃসঙ্গ মনে হতে থাকে। তখন সেটার সুযোগ নিয়ে তাকে কারখানায় কাজ করার প্রস্তাব দেয় স্বপন রক্ষিত। বিস্কুটের কারখানা কাজ দেওয়ার নাম করে স্বপন এবং তার স্ত্রী পাপিয়া রক্ষিত কিশোরীকে আবার বিক্রি করে দেয়। এবার নির্যাতিতা বিক্রি হয়ে পবিত্র বালা নামে দিল্লির এক ব্যক্তির বাড়িতে আসে। তখন তাকে লক্ষাধিক টাকায় বিক্রি করা হয়েছিল। তখন সেখানেই চলে যৌন অত্যাচার। তারপর তাকে দিল্লি থেকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে এসে বাগুইআটির বাসিন্দা সুমিত সেনের হাতে তুলে দেয় স্বপন। অত্যাচারের মাত্রা একই।
কেমন করে ফিরল স্বাভাবিক জীবনে? পুলিশ সূত্রে খবর, সুমিত সেন ওই কিশোরীকে পতিতাবৃত্তির পেশায় নামিয়ে দেয়। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতা পুলিশের অভিযানে ধরা পড়ে ওই কিশোরী। তখন গোটা ঘটনা নির্যাতিতা পুলিশকে জানায়। আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চেয়ে অনুরোধ করে। কিশোরীর অভিযোগের ভিত্তিতে শুরু হয় তদন্ত। গোয়েন্দা বিভাগের অ্যান্টি–হিউম্যান ট্রাফিকিং শাখার তদানীন্তন সাব–ইনস্পেকটর তন্দ্রিমা গুপ্ত (এখন ইনস্পেকটর তথা ওসি, স্পেশ্যাল জুভেনাইল পুলিশ ইউনিট) ২০১৪ সালে বসিরহাট, কলকাতা এবং দিল্লি থেকে গ্রেফতার করেন কুদ্দুস, ইসমাইল, পাপিয়া, পবিত্র ও সুমিতকে। এবার চলতি বছরের ১৮ মে বিচার শেষ হল। পাঁচ অভিযুক্তকেই পকসো আইন ও হিউম্যান ট্রাফিকিং প্রিভেনশন আইনের আওতায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড–সহ পাঁচ লক্ষ টাকা জরিমানার শাস্তি দিয়েছে আদালত।