পশ্চিমবঙ্গের যে সব আসনে যথার্থ ভাবেই ত্রিমুখী লড়াই হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তার মধ্যে অন্যতম হল মালদা দক্ষিণ। গনিখান চৌধুরীর পরিবার এখনও এখানে রাজনৈতিক ভাবে শক্তিশালী। এবারও সেই পরিবারের সদস্য ইশা খান চৌধুরী আছেন লড়াইয়ে। অন্যদিকে তৃণমূল দাঁড় করিয়েছে তরুণ শিক্ষাবিদ শাহনাওয়াজ আলি রায়হানকে। বিজেপির বাজি সমাজকর্মী শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরী।
মালদা দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্রটিও মালদা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রের মতোই ২০০৯ সালে আত্মপ্রকাশ করে। এর আগে এই আসন দু’টি মালদা লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ছিল। এই আসনটি তপশিলি জাতি বা, উপজাতিভুক্তদের জন্য সংরক্ষিত নয়। মালদা দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত বিধানসভা কেন্দ্র গুলি হল মানিকচক, ইংরেজবাজার, মোথাবাড়ি, সুজাপুর, বৈষ্ণবনগর, ফারাক্কা এবং শামশেরগঞ্জ। এই সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের কোনওটিই তপশিলি জাতি বা তপশিলি উপজাতিভুক্তদের জন্য সংরক্ষিত নয়। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আবু হাশেম খান চৌধুরী এই লোকসভা কেন্দ্র জয়লাভ করেছিলেন। ২০১৯ সালে ১৩ লক্ষ ৪৭ হাজারের কাছাকাছি মানুষ ভোটদানে অংশগ্রহণ করেছিলেন এই কেন্দ্রে।
এবার অবশ্য তিনবারের সাংসদকে টিকিট দেয়নি কংগ্রেস। তার বদলে টিকিট পেয়েছেন তার ছেলে। গনিখান পরিবারের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি ধরে রাখার এই লড়াই। গতবার অল্পের জন্য হারলেও এবার গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব কাটাতে আনকোরা অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করা শাহনাওয়াজের ওপর ভরসা তৃণমূলের। অন্যদিকে নির্ভয়া দিদি শ্রীরূপার ওপর ভরসা করেই মালদা দক্ষিণে খাতা খুলতে চাইছে বিজেপি। গতবার ভালো লড়েও অল্পের জন্য হেরে গিয়েছিলেন শ্রীরূপা। তৃণমূল গতবার তৃতীয় হলেও বিধানসভায় এর অন্তর্গত আসনগুলিতে একটা ছাড়া সবকটায় জিতেছিল জোড়াফুল। ফলে আশায় আছে রাজ্যের শাসক দলও।
পশ্চিমবঙ্গের মালদা এবং মুর্শিদাবাদ জেলা দীর্ঘদিন ধরেই জাতীয় কংগ্রেসের গড় হিসাবে পরিচিত হলেও সাম্প্রতিক কিছু বছরের তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির রাজনৈতিক প্রভাবও যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে এই দুটি জেলায়। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মালদা দক্ষিণ থেকে আবু হাশেম খান চৌধুরী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে জয়যুক্ত হন। এই নির্বাচনে প্রায় ৮ লক্ষ ৩১ হাজার মানুষ ভোটদানে অংশগ্রহণ করেছিল। আবু হাসান খান চৌধুরী তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে ১ লক্ষ ৩৬ হাজার ভোটে পরাজিত করে সাংসদ নির্বাচিত হন।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও দেখা যায় আবু হাশেম খান চৌধুরী প্রায় ১ লক্ষ ৬৪ হাজার ভোটে পরাজিত করেন নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে। এই নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ছিল প্রায় ১৩ লক্ষ ৪৭ হাজার। প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে জাতীয় কংগ্রেসের ভোটের শেয়ার ছিল ৯.৭ শতাংশ, অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিআইএম এবং বিজেপির ভোটের শেয়ার ছিল যথাক্রমে ৩৯.৮ শতাংশ, ২৩ শতাংশ এবং ১৭ শতাংশ। তবে ২০১৯ সালের নির্বাচনে রাজ্যজুড়ে অনেকখানি জনসমর্থন হারায় জাতীয় কংগ্রেস। তাদের ভোটের শেয়ার নেমে দাঁড়ায় ৫.৭ শতাংশ। বিজেপি প্রায় ৪০.৬ শতাংশ ভোট পেয়ে চমক দেয়। অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট শতাংশ গিয়ে দাঁড়ায় ৪৩.৭ শতাংশে। সিপিআইএম পায় ৬.৩ শতাংশ ভোট। তবে, ২০১৯ সালের নির্বাচনে মালদা দক্ষিণ কেন্দ্রটি হাতছাড়া হয়নি কংগ্রেসের। আবু হাশেম খান চৌধুরী ফের একবার এই কেন্দ্র থেকে জয়লাভ করেন, তবে তাঁর জয়ের মার্জিন কমে দাঁড়ায় ৮ হাজার।৷ সার্বিকভাবে রাজ্যজুড়ে জাতীয় কংগ্রেসের ভোটের শেয়ার ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে কিছুটা বাড়ে কিনা সেদিকেই নজর থাকবে বিশেষজ্ঞ থেকে রাজনৈতিক নেতা, সকলের। বর্তমানে ইংলিশ বাজারের বিধায়ক শ্রীরূপা আগে তৃণমূলে ছিলেন। মনমোহন সিং গঠিত নারী সুরক্ষা সংক্রান্ত নির্ভয়া কমিটিতে ছিলেন তিনি। এখন দল বদলেছেন, তবে থেকে গিয়েছে নামটি।
বিধানসভার ফলাফল
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের মালদা দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রে কেমন ফলাফল হয়েছিল, সেদিকেই এবার নজর রাখা যাক। মানিকচক বিধানসভা কেন্দ্রটি থেকে জয়যুক্ত হয় তৃণমূল কংগ্রেসের সাবিত্রী মিত্র। তিনি ১৬ শতাংশের বেশি ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে। ইংলিশ বাজার বিধানসভা ক্ষেত্রে দেখা যায় তৃণমূলকে হারিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টির শ্রীরূপা মিত্রচৌধুরী জয় যুক্ত হন ২০ হাজার ৯৯টি ভোটে। মোথাবাড়ির বিধানসভা কেন্দ্রে দেখা যায় আবার তৃণমূল কংগ্রেসের জয়। ইয়াসমিন সাবিনা তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ৫৬ হাজার ৫০০টির বেশি ভোটে পরাজিত করে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে। সুজাপুর, বৈষ্ণবনগর এবং ফারাক্কা এই তিনটি কেন্দ্রেও দেখা যায় জোড়াফুলের জয়। সুজাপুরে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী মোহাম্মদ আব্দুল গনি ১ লক্ষ ৩০ হাজারের বেশি ভোটে জয়যুক্ত হন। অন্যদিকে বৈষ্ণবনগরে জয়যুক্ত হন চন্দনা সরকার। ফারাক্কা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে মনিরুল ইসলাম ৬০ হাজারের কাছাকাছি ভোটে পরাজিত করেন নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে৷ ২০২৪ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রটি জাতীয় কংগ্রেস ধরে রাখতে পারে নাকি, অন্য কোনও রাজনৈতিক দল নতুন করে প্রভাব বিস্তার করে, সেদিকেই এখন তাকিয়ে মালদা দক্ষিণের মানুষ।