ঠাকুর বাড়ির ফ্যাশন এবং রুচিবোধ কিন্তু আমাদের অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ঠাকুর বাড়ির স্টাইল এবং কালচার একটা অন্য ধারা এনেছিল শিক্ষিত বনেদি বাঙালি সমাজে। এবং লক্ষ্য করা যায়, সেই স্টাইল কিন্তু ধিরে ধিরে ছড়িয়ে পড়ে আমাদের দেশ সহ সারা বিশ্বে। সেদিনের সেই স্টাইল এতটাই ভার্সেটাইল ছিল যে আজও ফ্যাশন দুনিয়া মজে রয়েছে ঠাকুর বাড়ির সেই নান্দনিক ধারায়। এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরের মেজ বৌঠান ও সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী প্রথম আমাদের এখানে শুরু করেন 'বম্বে স্টাইল'-এ শাড়ি পরা। স্বামীর সঙ্গে অনেকটা সময় তিনি বম্বেতে (বর্তমানে মুম্বই) কাটিয়েছিলেন। সেখানকার শাড়ি পরার স্টাইল এবং গুজরাটি,পার্সি মহিলাদের শাড়ি পরার ধরনে তিনি আকৃষ্ট হন। কুচি দিয়ে পরা শাড়ি এবং বাঁদিকে আঁচল তিনিই প্রথম ঠাকুর বাড়িতে আমদানি করেন। এই স্টাইল খুব তাড়াতাড়ি ঠাকুর বাড়ির মহিলা সহ শিক্ষিত, উন্নত, রুচিশীল ব্রাহ্মসমাজের মহিলাদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পাশাপাশি সাধারণ বাঙালি সমাজের মধ্যেও এই ভাবে শাড়ি পরার প্রচলন শুরু হয়। এবং আজও সেই স্টাইলই ‘ফ্যাশন ইন’। অন্য কোনও শাড়ি পরার ধরন আজও টেক্কা দিতে পারেনি রবীন্দ্রনাথের মেজ বৌঠানকে।
নতুন স্টাইলে শাড়ি পরার সঙ্গে সঙ্গে পেটিকোট এবং ব্লাউজ পরা চালু হয় এই জ্ঞানদানন্দিনীর হাত ধরেই। যা সেই সময় জ্যাকেট নামে পরিচিত ছিল। বিভিন্ন টুকরো কাপড় দিয়ে একটু আঁটোসাঁটো জামার মতো, কিন্তু লম্বায় খাটো জ্যাকে্টের মতো বানিয়ে তাতে সুন্দর সুন্দর লেস বসিয়ে,সুতোর কাজ করে তৈরি করা হত জ্যাকেট। আজ সেই জ্যাকেটেরই নাম হয়েছে ব্লাউজ। ভাবতে অবাক লাগে অতদিন আগে কত উন্নত ভাবনা ছিল তাঁর! আজ কত রকম এক্সপেরিমেন্ট চলছে এই ব্লাউজ নিয়ে, ধরা যাক একটা ইক্কত বা গাদোয়াল শাড়ি যদি পরা হয় তাহলে তার সঙ্গে থ্রি কোয়ার্টার হাতা ব্লাউজে কুচি দিয়ে লেস বসিয়ে পরলে খুব সুন্দর দেখাবে। ব্লাউজের গলার ক্ষেত্রে হাই নেক, বোট নেক, সামনে এবং পিঠের দিকেও হাই, হাতায় লেস বা প্লিট বসানো, সামনে বড় বাহারি বোতাম ওয়ালা, সারা গায়ে মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ হালকা সুতোর কাজ করা, এই বিভিন্ন ধরনের ফ্যশনবেল ব্লাউজ সেই যুগ থেকে আজও একই রকমভাবে অত্যন্ত জনপ্রিয়। বরং যত দিন যাচ্ছে ততই যেন ওল্ড ট্র্যডিশনাল ফ্যাশনের চাহিদা বাড়ছে।
পেটিকোটের ক্ষেত্রেও একই কথা বলব, সেদিনের জ্ঞানদানন্দিনীর সেই লেস বসানো হাতের কাজ করা এবং ক্রুসের কাজ করা পেটিকোট হয়ে উঠেছে আজকের ডিজাইনার পেটিকোট। হামেশাই বিভিন্ন ফ্যশন শোয়ে বা কোনও পার্টিতে অনেকেই মসলিন ধরনের শাড়ি বা লং ডিজাইনার ড্রেসের সঙ্গে ম্যাচ করা লেসের পেটিকোট পরেন, যা শাড়ি ও ড্রেসের ওপর দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায়। শাড়ির ভিতরে ঢাকা থেকে বলে পেটিকোটে কোনও কাজ করা বা ডিজাইন করা থাকবে না, এই ভাবনাটাই ভুল। এমন অনেক শাড়ি বা লং ড্রেস রয়েছে যা খুবই হালকা পাতলা মেটিরিয়াল দিয়ে তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে এই ডিজাইনার পেটিকোট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অত বছর আগের ভাবনায় আজও তৈরি হচ্ছে অসাধারণ সব ডিজাইনার ইনার ।
শুধুমাত্র পোশাকের ক্ষেত্রেই নয়, অন্যান্য সাজগোজ বা ফ্যশন অ্যাক্সেসারিজের ক্ষেত্রেও ঠাকুরবাড়ির ভাবনা ছিল অনবদ্য এবং অসম্ভব আধুনিক। এই যে চুলে আমরা এখন বাগান লাগাই, নানা রকম কাঁটা লাগাই, নানারকম খোপা বাঁধি, এমনকি গয়নার ক্ষেত্রেও, এই সবই কিন্তু সেযুগের ঠাকুর বাড়ির স্টাইল। এবং এতটাই রেলিভেন্ট যে সেই চর্চা আজও চলছে। বাঙ্গালিদের মধ্যে তো বটেই, সারা ভারত সহ গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে ঠাকুরবাড়ির স্টাইল ঘরানা।
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যে জোব্বা পরতেন সেই ধরনের জোব্বা তো এখনকার ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে ভীষণভাবে ইন। জোব্বার সঙ্গে যে বড় পাজামা পরতেন সেটাই কিন্তু আজকের পালাজো। এবং ওঁর টুপি, যার গায়ে খুব হালকা জারদৌসির কাজ করা থাকত, এই সব গুলোই বানাতেন বিশেষ মুসলিম টেলার। বোঝাই যায় তিনি যথেষ্ট সতর্ক ছিলেন নিজের স্টাইলের বিষয়ে। আজকাল মেয়েদের ফ্যাশনের ক্ষেত্রে পালাজো লং কুর্তা আর জোব্বা অত্যন্ত জনপ্রিয়। সারা বিশ্বে এখন জোব্বার ফ্যাশন চলছে। একটু হাই সোসাইটিতে, দেশবিদেশের ফ্যাশন শো'তে, বিভিন্ন বড় বড় পার্টিতে পুরুষদের এবং মডেলদের দেখা যায় জোব্বা পরেছে। এবং তাঁদের যে লুক তাতে রবীন্দ্রনাথের স্টাইল। এখন বেশ কিছু বিশিষ্ট মানুষদের দেখা যায় ওই টুপি পরতে। সেদিন সুনিতা কুমারকে দেখলাম একটি ছবিতে তিনি রবি ঠাকুরের আদলে একটি টুপি পরে অনুষ্ঠানে এসেছেন। একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় এই যে ফ্যাশন ট্রেন্ড যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে ঠিকই, কিন্তু ঠাকুর বাড়ির ফ্যশন, স্টাইলের প্রভাব বা চল এখনও সবকিছুতেই প্রবলভাবে বিস্তার করে রয়েছে।
আজ বলে নয়, চিরকালই আমি নিজে ঠাকুর বাড়ির ফ্যাশন দ্বারা প্রভাবিত। ইন্দো-ওয়েস্টার্ন ফিউশন করেই আমি কাজ করতে ভালোবাসি। আমার কাজের মধ্যে ঠাকুর বাড়ির ফ্যশনের প্রভাব লক্ষ করা যায়। আমার ব্লাউজের যে ডিজাইন সেটা আমি ঠাকুর বাড়ির ফ্যশন ফলো করেই করি। এই যেমন সিল্ক, মসলিন বা জর্জেটের মতো শাড়ির সঙ্গে বাঙালিয়ানা বজায় রাখতে ঘটিহাতা ব্লাউজ, বা ঘন বুটিওয়ালা কাজ করা ব্লাউজ, জারদৌসি কাজের ছোট্ট ফুল করা ব্লাউজ, তার সঙ্গে প্লিট বা লেসের কাজ, এই সব নিয়েই একটা ট্র্যাডিশনাল লুক দেওয়ার চেষ্টা করি। আমার খুব ইচ্ছে রয়েছে রবি ঠাকুর ও ঠাকুরবাড়ির স্টাইল, ফ্যশন নিয়ে আরও অনেক রকম কাজ করার। কারণ এটা আমার খুব ভালোবাসার একটি বিষয়। সারা পৃথিবীতে ফ্যাশন ডিক্টেট করে ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ড। তারাই ঠিক করে ফ্যাশন ট্রেন্ড। অথচ আমাদের অনেক কিছুই কিন্তু ওরা নকল করে, যেটা ওদের নিজস্ব নয়। যেমন ম্যডোনা সহ প্রচুর হলিউড স্টার টিপ বা বিন্দি পরছেন। হাতে মেহেন্দি, নাভিতে ট্যাটুর মত মেহেন্দি, নাকছাবি,বাঁধনি ও চিকন এই সবই এখন ওদের দেশে খুবই জনপ্রিয়। এর পাশাপাশি ঠাকুর বাড়ির ফ্যাশন এবং আমাদের ট্র্যাডিশনাল স্টাইল গুলোর দ্বারাও ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ড ভালো রকম প্রভাবিত। আমি চাই এই ওয়ার্ল্ড ফ্যাশনের ইতিহাসে ভারতের গুরুত্ব সারা দুনিয়া জানুক। সেটাই আমার চেষ্টা।