অসুস্থ বাবার জন্য AIIMS-এর বাইরে লাইনে দাঁড়িয়ে ছেলে। সেখান থেকে লিখলেন, ‘আমার বাবা মরে যাবে। তাড়াতাড়ি, খুব তাড়াতাড়ি মরে যাবে।’ তাঁর এই পোস্ট ঘিরে উত্তাল গোটা দেশ। কী হয়েছে তাঁর সঙ্গে?
সোমবার সন্ধ্যায় এই পোস্টটি করেন পল্লব সিং নামের একজন। তিনি এর পরে ধীরে ধীরে লেখেন, ঠিক কী ঘটেছে তাঁদের সঙ্গে। তিনি জানান, ‘আমি এক মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছি। ভারতের অধিকাংশ মানুষই যে ধরনের পরিবার থেকে আসেন। আর তার পরে আমার হাতে হাসপাতালের একটি বিল এসেছে। যেটি আমায় মধ্যবিত্ত থেকে গরিব হওয়ার দিকে এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। আমার বাবাকে আমি বোধহয় আর বাঁচাতে পারব না।’ এর পরে তিনি লেখেন, ‘চলতি বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল বাবার। আমার নিজের শহর উত্তর প্রদেশের দেওরিয়া থেকে গোরখপুরে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বাবাকে। তিনটি ধমনীতে ব্লকেজ ধরা পড়ে এবং হার্ট মাত্র ২০ শতাংশ কাজ করছে। আরও চিকিৎসার ভালো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়।’
তাঁর কথায়, ‘নভেম্বরের শেষ দিকে তাঁকে দিল্লিতে নিয়ে আসা হয়। আমার বোন AIIMS দিল্লিতে কার্ডিয়োলজিস্টের সঙ্গে দেখা করার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে ২৪ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অ্যাপয়েন্টমেন্ট পায়। আমি সত্যিই সেদিন ভাবিনি, বাবাকে বাঁচাতে পারব।কিন্তু ভাগ্যক্রমে সেদিন কিছুই ঘটেনি।’ পল্লব এর পরে জানান, একটি পরীক্ষার জন্য তাঁর বাবাকে এক সপ্তাহ পরের একটি তারিখ দেওয়া হয়। পরীক্ষা আগেই করা ছিল। তাঁর কথায়, ‘এর পরে কী হল? ECHO করার জন্য এক সপ্তাহ অপেক্ষা করে রইলাম। তার পরে চিকিৎসককে দেখানোর জন্য আরও ২৪ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ালাম।’
এর পরেই বড় অভিযোগ তোলেন তিনি। লেখেন, ‘ডাক্তারকে দেখানো হল। তিনি একজন অত্যন্ত নামী সিনিয়র অধ্যাপক। পদ্ম পুরস্কারপ্রাপ্তও। তিনি আমার বাবাকে দেখেন। বলেন, হার্ট খুব দুর্বল। ওষুধ লিখে দেন এবং পরে আসতে বলেন। হ্যাঁ, পরে। কিন্তু কোনও তারিখ দেন না!’
পল্লব জানিয়েছেন, তাঁরা এর পরে বুঝতে পারেন, রোগটি খুবই গুরুতর এবং জলদি অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন। প্রশ্ন, তাহলে ওই চিকিৎসক কোনও সার্জনের কাছে পাঠালেন না কেন? কোন ধারণা নেই তাঁদের। ৪৫ দিন ধরে তাঁরা বেসরকারি হাসপাতালে ঘোরাঘুরি করেন এবং বুঝতে পারেন যে সেখান থেকে অস্ত্রোপচার করা হলে তাঁদের যা আছে, তা বিক্রি করতে হবে। এমনকী বাড়ি পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে হতে পারে।
অতএব আবার AIIMS-এ। পল্লবের কথায়, ‘আবার AIIMS-এ ফিরে এলাম। লাইনে দাঁড়িয়ে অনেক দিন ধরে চেষ্টা করলাম। চিকিৎসকের দেখা পেলাম না। কারণ তিনি ছুটিতে। কবে আসবেন? কোনও ধারণা নেই। এর পরে কী? অপেক্ষা। অবশেষে চিকিৎসক এলেন। ১৫ দিন অপেক্ষার পরে। আবার ২৪ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ালাম। এবার চিকিৎসক সার্জারির জন্য পাঠালেন। এখন কেন? আগে বলেননি কেন? বাবার হার্ট মাত্র ২০ শতাংশ কাজ করছে! কোনও ধারণা নেই।’ তিনি লিখেছেন, এর পরে সেই দিনই সার্জনের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পান তাঁরা। তাঁর বক্তব্য, বিস্ময়কর হলেও কথাটা সত্যি। তবে সেখানেই শেষ নয়। তাঁর কথায়, ‘অ্যাপয়েন্টমেন্টের সময় দেওয়া হল দুপুর ২টো। চিকিৎসক এলেন ৫ সন্ধ্যা ৬টায়। চার ঘণ্টা ঠান্ডার মধ্যে একজন হার্টের রোগীকে লোহার চেয়ারে বসিয়ে রাখতে হল।’
পল্লব লিখেছেন, ‘চিকিৎসক ডকুমেন্টগুলি রেখে পরের দিন আসতে বললেন। যাতে তিনি সেগুলি দেখার পর্যাপ্ত সময় পান। মেনে নিলাম। পরের দিন গেলাম। শুক্রবার। ৭টা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। তার জন্য ৫ ঘণ্টা বসে রইলাম। জানানো হল, সেদিন আর আসবেন না চিকিৎসক। সোমবার আসতে হবে। সেটাও মেনে নিলাম। অন্য কোনও বিকল্প তো নেই। এর পরে কী? এখানে অপেক্ষা করছি এবং এটা সোমবার। উনি আসবেন কি না ধারণা নেই। সত্যি কথা বলতে, ওঁর প্রতি আমার কোনও অভিযোগ নেই। কিন্তু একজন অসুস্থ হয়ে পড়লে, কী হতে পারে, সেটা বলছি।
পল্লব লিখেছেন, ‘আমি জানি এর পরে কী হবে। তিনি কিছু পরীক্ষা করাতে বলবেন এবং তার ফল দেখানোর জন্য ফিরে আসতে বলবেন। তার পরে আমি পরীক্ষার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে এক কাউন্টার থেকে অন্য কাউন্টারে ছুটব। অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাব এক মাস পরে। তার পরে চিকিৎসক হয়তো অপারেশনের তারিখ বলবেন। সেটাও হয়তো আগামী বছর। আমার বাবাইনসুলিন নেওয়া ডায়াবেটিক রোগী। ৫২ বছর বয়স। হার্ট মা্র ২০ শতাংশ কাজ করে। তার অস্ত্রোপচারের জন্য কমপক্ষে ১৩ মাস অপেক্ষা করতে হবে। সেটাও বিনামূল্যের অপারেশন নয়, অন্তত এক লাখ টাকা খরচ হবে। এই অবস্থায় তার এতদিন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কম। আর আমার চাকরি ছাড়া আমাদের আয়ের বড় কোনও উৎসও নেই।’
এর পরে পল্লব জানিয়েছেন, মস্তিষ্কের সমস্যা নিয়ে তাঁর মাও দীর্ঘ দিন ধরে এই AIIMS-এই চিকিৎসাধীন। তাঁদের ৪ জনের পরিবারের ২ জন ইতিমধ্যেই অসুস্থ। তাঁর আর কোনও সম্বল নেই বলেও জানিয়েছেন।
শেষে তিনি লিখেছেন, ‘আমি যদি মন্ত্রী হতাম, তাহলে একই হাসপাতাল আমার পিছনে দৌড়োতো এবং আমার অস্ত্রোপচার বহু দিন আগেই হয়ে যেত। কিন্তু আমি মধ্যবিত্ত একজন মানুষ। আমি একজনভোটার। ভোটের সময়ে আমি রাজা এবং তার পরে কেউ নই। আক্ষরিক অর্থেই, কেউ নই। আমরা যে সিস্টেম তৈরি করেছি তা কী বিশৃঙ্খলায় ভর্তি। হ্যাঁ, আমাদের সবার ভূমিকা আছে। হয়তো আমরা কেউ আমাদের দায়িত্ব পালনে পরিশ্রম করিনি। কেউ দুর্নীতিবাজ, কেউ অসৎ। আমি বুঝতে পারি আমরা কীসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এটি আমার একার গল্প নয়, এটি এখানকার বেশিরভাগ মানুষের গল্প।
তিনি এই লিখে শেষ করেছেন, ‘প্রতি রাতে আমার বাবার বিছানার পাশে বসে আমি প্রার্থনা করি, কিছু সাহায্য যেন আসে এবং বাবা যেন ভালো চিকিৎসা পায় আর সেটা সময়মতো পায়। আমি জানি না, কোন ধরনের সাহায্য আমার দরকার। শুধু এটুকু জানি, সেটা দরকার। আমি বিধ্বস্ত, কোনও পয়সা নেই। কোনওক্রমে বেঁচে আছি।অন্তত এখনকার মতো!’
পল্লবের এই পোস্ট দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়। সারা দেশের মানুষ এই লেখা সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেছেন। এমনকী বহু ধরনের পরামর্শও এসেছে তাঁর জন্য। মুম্বই থেকে চিকিৎসকরা পর্যন্ত তাঁকে লিখেছেন, বাবাকে নিয়ে সেখানে যেতে। দ্রুত চিকিৎসা পাবেন। যদিও এই পোস্ট ভাইরাল হয়ে যাওয়ায় সাহায্যের প্রতিশ্রুতি এসেছে AIIMS-এর তরফেও। পল্লব মঙ্গলবার দুপুরে জানিয়েছেন, AIIMS-এর তরফে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। এখনও অনেক পথ চলা বাকি। তবে তিনি আশা দেখছেন। পাশাপাশি সকলকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, এই পরিস্থিতিতে তাঁর পাশে থাকার জন্য, তাঁকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য। তবে এখনই সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে তিনি কথা বলতে পারবেন না বলেও জানিয়ে দিয়েছেন পল্লব।
যদিও শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, পল্লবের এই পোস্টে কাজ হয়েছে। AIIMS কর্তৃপক্ষ তো বটেই খোদ মন্ত্রীর তরফেও আশ্বাস এসেছে বলেই শোনা গিয়েছে।