জলবায়ু পরিবর্তনের অনেক প্রভাব মানুষ এখনই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন৷ কিন্তু লোকচক্ষুর অন্তরালে হিমবাহের গতিপ্রকৃতির উপরও সমুদ্রের জলের উচ্চতা নির্ভর করছে৷ তাই বিজ্ঞানীরা বরফের সেই জগত আরও ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করছেন৷
সুইজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতের উপর রোন হিমবাহের উপর গবেষকরা অসাধারণ ঘটনার অনুসন্ধান করছেন৷ হিমবাহ কীভাবে এগিয়ে চলে এবং ধীরে হলেও নীচের উপত্যকায় গড়িয়ে পড়ে, আরও ভালোভাবে তা জানতে চান তাঁরা৷ গ্লেসিয়ারের এই চলনশীলতা গোটা বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ৷ গবেষক দলের অন্যতম সদস্য ফাবিয়ান ভাল্টার বলেন, ‘রোন-সহ বিশ্বের সব হিমবাহই নীচের দিকে এগিয়ে চলেছে বলে গোটা বিশ্বের জন্য এটা প্রাসঙ্গিক৷ সবচেয়ে বড় বরফের চাদরের উপর একাধিক বিশাল হিমবাহ রয়েছে, যেখানে স্লাইডিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া৷'
হিমবাহের ‘স্লাইডিং' প্রক্রিয়ার গতিপ্রকৃতি দেখে জানা যায়, যে সেটি সামনের দিকে এগোচ্ছে, পিছনে টান পড়ছে না স্থিতিশীল রয়েছে৷ গ্লেসিয়ার মুভমেন্ট না বুঝলে আমরা ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দিতে পারব না৷ বলতে পারব না, সেটির আচরণ কেমন হবে, সমুদ্রে জলের উচ্চতা বাড়ার ক্ষেত্রে সেটির ভূমিকা কী হবে৷'
মাধ্যাকর্ষণ শক্তি গ্লেসিয়ারের বেসের উপত্যকার দিকে টানে৷ ব্যাপারটা অনেকটা মধুর স্রোতের মতো৷ বরফ উপত্যকার মাটির উপর দিয়ে যাওয়ার সময় পাথরের মতো বাধার সম্মুখীন হতে পারে৷ চাপ খুব বেড়ে গেলে বরফের স্তর কখনও ভূমিকম্পের মতো আচমকা নড়ে ওঠে৷ এমন ‘আইসকোয়েক' বা ‘বরফকম্প' উপরিভাগে ঘটলে অতি সংবেদনশীল ফাইবার অপটিক কেবল দিয়ে পরিমাপ করা সম্ভব৷ হিমবাহের গতিবিধি টের পেতে সেটি গুরুত্বপূর্ণ এক সূচক৷ হিমবাহ বিশেষজ্ঞ হিসেবে ফাবিয়ান ভাল্টার বরফের মধ্যে এমনই এক কেবল পেতেছেন৷ তিনি বলেন, ‘এই কেবলের মাধ্যমে আমরা কয়েকশো মিটার গভীরে উঁকি দিতে পারি৷ হিমবাহের গভীর অংশ থেকে কম্পন এলে আমরা সেটি পরিমাপ করতে পারি৷'
হিমবাহের গতিবিধি বুঝতে বিস্তীর্ণ অংশজুড়ে আইসকোয়েক পরিমাপ করা অত্যন্ত জরুরি৷ কম্পিউটারের বিশ্লেষণের মাধ্যমে গ্লেসিায়ারের ভেতরে টানাপড়েন টের পাওয়া যায়৷ ফাবিয়ান ভাল্টার সেই প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘কেবলের মাধ্যমে আমরা যে কম্পন রেকর্ড করছি, তার ভিত্তিতে এই রিয়েল লাইফ ডেটা পাওয়া যাচ্ছে৷ গ্লেসিয়ার বেড বা বেদির ব্যাপারে আমাদের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি৷ সেটাই হিমবাহের ডাইনামিক্সের কেন্দ্র৷ কোনও হিমবাহ বিশাল পরিমাণ বরফগলা জল সৃষ্টি করলে সেই জল জমে বেদি খুব দুর্বল হয়ে ওঠে এবং হিমবাহ পিছলে শুরু করে৷ বিশ্বের যে সব হিমবাহের বেদি জমাট নয়, সেখানে এমন স্লাইডিং প্রক্রিয়া দেখা যায়৷ সেটাই ‘গ্লেসিয়ার ডাইনামিক্স'-এর উৎস৷'
হিমবাহের গতিশীলতা ভিতরের জলের উপরেও নির্ভর করে৷ পোর্টেবল রাডার যন্ত্রের মাধ্যমে গবেষকরা সেই পানি শনাক্ত করেছেন৷ অর্থাৎ ডাইনামিক্সের উপর গলা জলেরও প্রভাব রয়েছে৷ হিমবাহের উপর চিড় বা গর্তের মাধ্যমে জলের ভিতরে প্রবেশ করে৷ তারপর গ্লেসিয়ার বেডে পৌঁছে একেবারে চূড়ান্ত প্রান্তে চলে যায়, যা ‘স্নাউট' নামে পরিচিত৷ পানি সেখানে লুব্রিকেন্ট হিসেবে ঘর্ষণ কমায় বলে হিমবাহ আরেও দ্রুত গতিতে পিছলে যায়৷
রোন নদীর উৎসের মতো আল্পস পর্বতের গ্লেসিয়ারগুলি বছরে সর্বোচ্চ ২০০ মিটার পিছলে যায়৷ অন্যদিকে গ্রিনল্যান্ডের বিশাল বরফের চাদর বছরে ৭,০০০ মিটার পর্যন্ত এগিয়ে যেতে পারে, যার গতি আল্পসের তুলনায় ৩৫ গুণ দ্রুত৷ কিন্তু সেগুলি বয়ে চলার প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া সব ক্ষেত্রেই এক৷ ফলে আল্পস পর্বতে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, সেটি কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা গ্রিনল্যান্ডের হিমবাহের গতিপ্রকৃতিও আরেও ভালোভাবে বুঝতে পারবেন৷