জন্ম থেকেই সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত। কিন্তু তাতে দমে যাননি পশ্চিম বর্ধমানেরর দুর্গাপুরের মেয়ে দেবস্মিতা নাথ। বরং সেই শারীরিক সমস্যাকে অতিক্রম করে কবিতা আবৃত্তির জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যে মেয়েকে একটা সময় বাঁকা চোখে দেখতেন আশপাশের লোকজন, আজ তাঁকেই স্বীকৃতি দিয়েছে দেশ ও রাজ্য।
সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত হওয়ায় অঙ্গের সঞ্চালন অত্যন্ত দেরিতে হয়। দেবস্মিতার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। তিনি যে পুরোপুরি কোনওদিন সুস্থ হয়ে উঠবেন না, তা ছোটোবেলাতেই জানিয়ে দিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। তবে মেয়েকে যতটা স্বাভাবিক জীবনে (তথাকথিত অবশ্যই) ফিরিয়ে আনা যায়, তার জন্য লড়ে যেতে থাকেন বাবা দেবাশিস এবং মা সুস্মিতা। ছোটোবেলা থেকেই দেবস্মিতার ফিজিয়োথেরাপি শুরু হয়েছিল। মেয়ে কোনটা ভালোবাসে, তা অনুভব করানোর জন্য সাঁতার, অঙ্কনের প্রশিক্ষণও দিয়েছিলেন বাবা-মা। তারইমধ্যে স্কুলে পড়ার সময় কবিতার প্রেমে পড়েন দেবস্মিতা। যে সম্পর্ক আজও অমলিন, অটুট।
দেবস্মিতার মা জানান, তিন বছরে তাঁকে একটি স্কুলে ভরতি করা হয়েছিল। কিন্তু স্কুলে সহ্য করতে হচ্ছিল কটূক্তি। দেবস্মিতার বয়স যখন পাঁচ, তখন স্কুলেরই এক আবৃত্তি প্রতিযোগিতা মেয়ের জীবন পালটে দেয়। সেই প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়েছিলেন দেবস্মিতা। সেই সূত্রেই এক শিক্ষিকার কাছে আবৃত্তি শিখতে থাকেন। সেই শিক্ষিকার হাত ধরে ছোট্ট-ছোট্ট পা ফেলে এগিয়ে যেতে থাকেন। তবে সেই পরিচিতির মধ্যেও কটূক্তি থেকে রেহাই পেতেন না। স্কুলে দেবস্মিতাকে কটূক্তি করা হত বলে অভিযোগ করেছেন দেবস্মিতার মা।
সেইসব বাধা অতিক্রম করেই এগিয়ে যেতে থাকেন দেবস্মিতা। রবীন্দ্র জয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তীর সময় আবৃত্তি করে যেতে থাকেন। অন্যান্য জায়গাতেও পরিচিতি গড়ে উঠতে থাকে। ন'বছরে রাজ্যস্তরের আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার পর পরিচিতি আরও বাড়ে। বিভিন্ন টেলিভিশন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে থাকেন। দেবস্মিতার বয়স যখন ১৩, তখন ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওয়ার্কশপে যোগ দিয়েছিলেন। দেবস্মিতার মা জানিয়েছেন, সেইসময় প্রদীপ ঘোষ, গৌরী ঘোষ, জগন্নাথ বসু, ঊর্মিমালা বসুদের থেকেও তালিম পেয়েছিলেন মেয়ে। তাঁদের তালিমে নিজেকে আরও মেলে ধরতে থাকেন দেবস্মিতা।
তারই রেশ ধরে ১৫ বছরে সারা বাংলা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় প্রথম হন দুর্গাপুরের মেয়ে। দু'বছর পরেই দেবস্মিতার প্রথম সিডি প্রকাশিত হয়। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় আবৃত্তি করতে থাকেন। চলতি বছর তাঁর দ্বিতীয় সিডি (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নজরুল কবিতা সংকলন) প্রকাশিত হয়েছে। যিনি ইন্ডিয়ান ফটো লাভার্স ও কালচারাল ফাউন্ডেশনের বঙ্গ শাখা থেকে কনিষ্ঠতম বাচিকশিল্পী হিসেবে পঞ্চম প্রমীলা কৃতী রত্ন সম্মান-সহ দেশ এবং রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু সম্মান পেয়েছেন। চলতি বছরেই বিশ্ব বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি গৌরব সম্মান, অসমের কৃষ্টি সম্মানে ভূষিত হয়েছেন দেবস্মিতা। দিনকয়েক আগেই কলকাতা বইমেলায় দেবস্মিতাকে শঙ্খ ঘোষ স্মৃতি সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে।
সেইসবের মধ্যেই বিনা পারিশ্রমিকে আর্থ-সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া শিশুদের পড়ান দেবস্মিতা। কবিতা শেখান। আবৃত্তির মাধ্যমে নিজে যা উপার্জন করেছেন, তা দিয়ে করোনাভাইরাসের সময় অনেককেই সাহায্যও করেছেন। যে বাচ্চাদের হয়ত কোনও দেবস্মিতা লুকিয়ে আছে।