বাঘা যতীন বলেছিলেন তিনি হয় ‘স্বাধীন দেশের নাগরিক’ হয়ে ফিরবেন নইলে ‘স্বাধীন দেশের স্বপ্ন’ হয়ে। মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে দ্বিতীয়টাই হয়ে ফিরেছিলেন তিনি। তবে দেব প্রমিজ করেছিলেন স্বাধীন দেশকে বাঘা যতীনের গল্প বলবেন। সেটাই করলেন। তবে কেবল বাঘা যতীন নয়, আরও একাধিক বীর বিপ্লবীর গল্প উঠে এল এই ছবিতে।
পুজোর আমেজেও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছবি! চলবে? আলবাৎ চলবে। এই ছবিকে যে চলতেই হবে। এই ছবি যে ইতিহাসের পাতার কোনও এক কোণায় লুকিয়ে থাকা একাধিক নাম, বা নাম না থাকা দেশ মায়ের বীর সন্তানদের গল্প বলে, আর সেই ছবি যে দেখতেই হবে। এবার প্রশ্ন কেমন হল? দেব কি উত্তীর্ণ হলেন বাঘা যতীন হিসেবে? এটা জানার আগে চলুন অন্য কয়েকটা কথা বলা যাক।
অরুণ রায়ের যা ট্র্যাক রেকর্ড তাতে সকলেরই জানা যে উনি চরিত্রের জন্য কীভাবে অভিনেতা বাছেন। তাই অনেকে সন্দিহান হলেও আমার বিশেষ সন্দেহ ছিল না। আর সেটারই প্রমাণ পেলাম। ছবির শেষে যখন আসল বিপ্লবীদের সঙ্গে পর্দার বিপ্লবীদের ছবি দেখানো হয় হুবহু না হলেও বেশ মিল পাওয়া যায় তাঁদের গঠন, লুকসে। ফলে চরিত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রে কেবল পাস মার্কস নয়, বলা যায় প্রায় ফুল মার্কস পেয়েছে এই ছবি।
এবার আসি অভিনয়ের কথায়। দেব ভাঙছেন, গড়ছেন নিজেকে নিয়ে। সীমাবদ্ধ করে রাখেননি। এই ছবি যেন তার আরও একবার প্রমাণ দিল। কিছু জায়গায় উচ্চারণের ক্ষেত্রে একটু এদিক ওদিক থাকলে অভিনয়ের দিক থেকে বেশ ভালো তিনি। তাঁর চরিত্রর মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন যে বাঘা যতীন যেমন সুদক্ষ সরকারি কর্মী ছিলেন, তেমনই ছিলেন একজন বাবা, একজন স্বামী, একজন ভাই এবং অবশ্যই দেশ মায়ের বীর সন্তান। তাঁর চরিত্রের প্রতিটি দিক সুনিপুণ ভাবে ছবিতে দেখানো হয়েছে।
আরও পড়ুন: দেব ছাড়া বাংলা ছবিকে কেউ ব্যবসা দিচ্ছে না? বিতর্কের উত্তরে কী বললেন 'বাঘা যতীন'?
আরও পড়ুন: ‘জওয়ান,পাঠান যেখান থেকে করেছে…’, বাঘাযতীনের গানের প্রযুক্তিতে লেগেছে বিশাল টাকা, ফাঁস করলেন দেব
সৃজা দত্ত নবাগতা হলেও অল্প দৃশ্যে নজর কাড়লেন। তিনি যে লম্বা রেসের ঘোড়া প্রথম সুযোগেই বেশ বুঝিয়ে দিলেন। অন্যদিকে সুদীপ্তা চক্রবর্তীর কথা আর কীই বা বলি, এই ছবিতে তাঁর যতটা সুযোগ ছিল তিনি করেছেন। বুঝিয়েছেন বাঘা যতীনের মতো বিপ্লবীরা এগোতে পেরেছেন তাঁদের মতো দিদি, মা, বাবা থাকার জন্যই।
অন্যান্য চরিত্রে থাকা কোলাজ সেনগুপ্ত, রোহন ভট্টাচার্য, সামিউল আলম সহ অন্যান্য যে অভিনেতারা যে চরিত্রে ছিলেন সকলেই তাঁদের অংশটুকু সেরা দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন।
বেশ কিছু দৃশ্য আলাদা ভাবে নজর কেড়েছে এই ছবির। যেমন ক্ষুদিরামের বম্ব ছোঁড়ার দৃশ্য বা তাঁকে প্রফুল্ল চাকীর কাটা মুণ্ড যখন দেখানো হয় সেটা, অথবা আশু বিশ্বাসের হত্যার দৃশ্য গায়ে কাঁটা দিতে বাধ্য। দেব থুড়ি বাঘা যতীন যখন শেষবার বিদায় নিয়ে বুড়িবালাম যাচ্ছে সেই দৃশ্য আপনার চোখে জল আনবেই।
বাঘা যতীন ছবির সংলাপ বিশেষ ভাবে প্রশংসা পাওয়ার দাবি রাখে। এখানে দেবের মুখে 'যতীন মুখার্জি হয় লড়ে নইলে মরে ধরা পড়ে না' বা 'আমি ভারতীয় এটাই আমার পরিচয়' হুংকার গায়ে কাঁটা দেবে। কিন্তু শেষ পাতে বাজি মারল 'দেশের মানুষ চিন্তা ভাবনা স্বাধীন হবে আদৌ? আজ ব্রিটিশ শাসকের গোলাম, কাল অন্য কারও গোলাম হবে' সংলাপ। কথাটা কি খুব ভুল, বলুন তো?
বাঘা যতীনের প্রতিটা গান যেন ছবির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গানগুলি যেন এক একটা গল্প বলল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের, তাঁদের বীর গাঁথার। অরিজিতের কণ্ঠে ‘আসব ফিরে’ বা রূপমের ‘এই দেশ আমার’ বিশেষ প্রশংসা পাওয়ার দাবি রাখে।
তবে খারাপ কি কিছুই নেই? আছে মশাই আছে। প্রথম ভাগের শুরুতে একটু বেশিই প্রাককথন দেখানো হয়েছে যা না দেখালেও চলতো, যদিও হিস্টোরি রিভাইস করতে মন্দ লাগেনি। এছাড়া প্রথম ভাগে এত টুকরো টুকরো ঘটনা দেখানো হয়েছে যেগুলো আরও সুন্দর ভাবে হয়তো গাঁথা যেতে পারত। তবে মোটের উপর পুজোর হইহইয়ের মধ্যে এই ছবি যেমন দেশের প্রতি আরও টান জাগাবে, ইতিহাসকে জানাবে তেমনই সাহস দেবে। ফলে পুজোয় একদিন দেখে আসুন এই ছবি, বিশেষ করে বাড়ির খুদে সদস্যটিকে দেখান অতীত, ইতিহাস জানার জন্য কারণ জানেন তো আমরা যা দেখি সেটা বেশিদিন মনে থাকে।