ভারত স্বাধীন হয় ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট। ঠিক তার দু’বছর আগে ওই একই দিনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হার মেনে নেয় ভারত থেকে ৬ হাজার কিলোমিটার দূরের এক দেশ। ১৯৪৫ সালের ১৫ অগস্টের আগের কয়েক দশক জাপানকে ভয়াবহ কিছু ঘটনার সাক্ষী থাকতে হয়েছিল। তার পরের ইতিহাস প্রায় সকলেরই জানা। পরমাণু বোমা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়। সব মিলিয়ে ১৯৪৫ সালের ১৫ অগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় এই দেশ। সম্রাট হিরোহিতো আত্মসমর্পন করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওই দিন ‘Victory over Japan Day’ পালন করা হয়।
যে জাতি কখনও পরাধীন ছিল না, যে দেশে কখনও উপনিবেশ হয়নি, সে দেশ হঠাৎ করেই এক প্রকার স্বাধীনতা হারায়। কিন্তু এ লেখা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা জাপানের ইতিহাস নিয়ে নয়। বরং ভারতের স্বাধীনতা দিবসের সকালে এই লেখা লিখতে বসার কারণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়ে জাপানের পরিস্থিতি আলোচনার জন্য।
এ পর্যায়ে দেশ থেকে দূরে এসে কেটে গিয়েছে টানা ১০ বছর। মাঝে ঘটে গিয়েছে করোনা সংক্রমণের মতো ঘটনা। এত বছর জাপানে থাকার পরে ভারতীয় হিসাবে ভাবতে বসলেই প্রথম যে কথা মনে পড়ে, তা দুই দেশের সাযুজ্যের বিষয়। ভারতের মতো জাপানও ভাতের দেশ। সেই ভাতকে জাপানের মানুষ বলেন সুশি। যদিও এটি আমাদের চেনা ডাল-ভাত নয়। তবে এটিও যথেষ্ট সুস্বাদু খাবার। ভারতের মতো জাপানে এত উর্বর জমি নেই বটে, কিন্তু এখানেও রয়েছে বহু প্রদেশ এবং উপজাতির ভিত্তিতে প্রভেদ। এই সব উপজাতি, এবং ভাষার ভিত্তিতে তৈরি হওয়া সম্প্রদায়গুলির মধ্যে বহু বছর ধরেই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। তবে দেশে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়ে এসেছেন সামুরাইরা। গুরুত্ব এবং সুযোগসুবিধা। ভারতে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মতোই। বহু বছর ধরেই বিদেশের সামনে নিজেদের সংস্কৃতির দরজা খুলে দেয়নি এই দেশ। বরং নিজেদের প্রাচীন ধারণা, স্থাপত্য, জীবনধারা বা এমনকি যুদ্ধের কৌশলগুলি নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন তাঁরা। কিন্তু তার পরে শুরু হল এডো সাম্রাজ্য।
এডো রাজবংশ জাপানের দখল নেওয়ার আগে চিন, ডাচ এবং পর্তুগিজদের সঙ্গে এ দেশের বাণিজ্যিক, সাহিত্যিক এবং সামরিক সম্পর্ক ছিল বটে, কিন্তু অন্যান্য জাতির লোকদের সংস্কৃতিকে খোল মনে গ্রহণ করার ধারণাটি একেবারেই ছিল না। এখনও রক্ষণশীল জাপান। তবে ১৯ শতকের মাঝামাঝি মেইজি পুনরুদ্ধারের সময়ে জাপানের সঙ্গে পাশ্চাত্যের সম্পর্ক গভীর হতে থাকে। এটি জাপানকে সারা বিশ্বের কাছে নিয়ে যায়। তারপর আসে দু’টি বিশ্বযুদ্ধ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অক্ষত থাকলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জাপানকে বহু বছর পিছিয়ে দেয়। এবারই খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা। যদিও আমাদের, অর্থাৎ ভারতীয়দের কাছে ব্রিটিশরা শত্রু, আমরা জানি, তারা ভারতকে লুট করেছিল এবং আমাদের দেশকে আরও দারিদ্রের মুখে ঠেলে দিয়েছিল, এবং আমরা তা নিয়ে অভিযোগই করে গিয়েছে, জাপান তা করেনি। বরং তারা এই পরিস্থিতির মধ্যেও উলটে লড়াইয়ের রাস্তা বেছে নিয়েছিল। তাদের অপমানজনক পরাজয়ের পরে তারা যে লড়াই শুরু করে, তাও সম্পূর্ণ নিজস্ব কায়দায়। তারা প্রথম বিশ্বের দেশ এবং অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ হিসাবে আবির্ভূত হয়। যদিও আমরা এখনও আমাদের হাতের বাইরে থাকা ক্ষমতাকে দোষারোপই করে যাই, কিন্তু জাপান দেখিয়েছে সেই ক্ষমতা কী করে নিজের হাতে নিতে হয়, হারানো গৌরব কী করে পুনরুদ্ধার করতে হয়। আর ভারতের স্বাধীনতা দিবসের সকালে এ দেশে বসে এটাই সবচেয়ে বেশি করে মনে পড়ে।
ঠিক কী হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর থেকে? জাপান তাদের দেশ, ভাষা এবং সংস্কৃতি নিয়ে বিরাট গর্বিত। একটি সমাজ হিসাবে বিদ্যমান থাকার ধারণাই জাপানের সংস্কৃতিতে রয়েছে। তাই সেখানে ব্যক্তি গুরুত্বহীন। সেই কারণেই অন্যের প্রতি সহানুভূতি এবং বিশ্বাস এই দেশকে মাথা তুলে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। প্রায় ১২৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই ছোট দেশটি মানুষে মানুষে এই সম্পর্কের কারণে এতটা পথ হেঁটে এসে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে। প্রতিদিনের জীবনে ভ্রাতৃত্ব এবং গ্রহণযোগ্যতার ছাপ প্রতিটি মানুষের জীবনে স্পষ্ট। যদিও তাঁদের মধ্যে প্রায় কোনও অহঙ্কার নেই। আ সেটিই বোধহয় তাঁদের থেকে সবচেয়ে বেশি করে শেখার।
এখানকার ট্রেন স্টেশনগুলির এসকেলেটরে মানুষ একপাশে পরপর দাঁড়ান। যাতে যাঁদের তাড়া আছে, তাঁরা অন্য পাশ দিয়ে এগিয়ে যেতে পারে। রাস্তায় আঁকা তীরচিহ্ন তাঁরা সবসময় মেনে চলেন। রাস্তার একপাশে এক মাইল লম্বা লাইন থাকলেও মানুষ সে লাইন ভাঙেন না। মাস্ক পরা হয় নিজেকে রোগ থেকে রক্ষা করার জন্য নয়, অজান্তে রোগ ছড়িয়ে অন্যদের সংক্রমিত না করার জন্য।
জন্মের সময় মৃত্যু প্রায় অকল্পনীয় এ দেশে। মানুষের জীবন এখানে বিরাট মূল্যবান। দুর্ঘটনায় বৃড় গাড়িকেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তাই যিনি যত বড়, যত বেশি শক্তিশালী— তিনি ততই সতর্ক থাকেন। একই ধরনের অপরাধের জন্য গরিবদের চেয়ে ধনীদের বেশি জরিমানা হয়। যেহেতু দেশের প্রায় ১০০ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত এবং সামাজিক সুবিধাগুলি প্রায় সকলেই পান, তাই ছোট চুরি খুব বিরল। লাইসেন্স ছাড়া অস্ত্র রাখা কঠোর শাস্তিযোগ্য এবং আপনার লাইসেন্স থাকলেও অস্ত্র প্রকাশ্যে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায় না। বন্দুকের লাইসেন্স পাওয়াটাই এতটা ক্লান্তিকর যে, অনেকেই হাল ছেড়ে দেন। দেশের বেশিরভাগই বৌদ্ধ বা শিন্টো এবং অল্প কিছু মানুষ খ্রিস্টান। জাপানের মানুষ ধর্মীয় বিষয়ে খুবই ব্যক্তিগত এবং আবেগহীন। নিজেদের ধর্ম নিজের কাছে রেখেই এগিয়ে চলেন তাঁরা। অন্যের বিষয়ে প্রায় নাক গলান না।
প্রায় ১০ বছর জাপানে থাকার পর এই দেশ আমাকে যা শিখিয়েছে তা হল— স্বাধীনতা মানে শুধু স্বাধীনতা নয়, দায়িত্ব নেওয়াও। যদিও সার্বজনীনতা এখনও দেশপ্রেমের উপর উঠে আসতে পারেনি। কিন্তু জাপান সেই পথেই এগিয়ে চলেছে।
ইতি
কুমারশঙ্কর রায়