গুয়াহাটি লোকসভা কেন্দ্রটি অসম রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি লোকসভা কেন্দ্র। বর্তমানে কেন্দ্রটিতে কোন রিজার্ভেশন নেই। ১৯৫২ সাল থেকে এই লোকসভা কেন্দ্রে নির্বাচন হয়ে আসছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রটি থেকে জয়যুক্ত হন ভারতীয় জনতা পার্টির রানী ওজা। উত্তর-পূর্বের এই গুরুত্বপূর্ণ লোকসভাটি দশটি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে গঠিত। কেন্দ্রগুলি হল দুধনাই, বোকো, ছায়াগাঁও, পলাশবাড়ি, জালুকবাড়ি, দিসপুর, গুহাটি পূর্ব, গুয়াহাটি, পশ্চিম হাজো এবং বারক্ষেত্রী। অসম রাজ্যের গোয়ালপাড়া, কামরূপ মেট্রো এবং নলবাড়ি জেলাগুলিতে এই লোকসভা কেন্দ্র বিস্তৃত। ১৯৫২ থেকে লোকসভা নির্বাচনগুলিতে এই কেন্দ্রে বিভিন্ন নির্বাচনে কখনও জাতীয় কংগ্রেস, কখনও প্রজা সমাজতান্ত্রিক দল, কখনও কমিউনিস্ট পার্টি, অসম গণপরিষদ বা বিজেপি জয়লাভ করেছে৷ এবারও প্রধান লড়াই বিজেপি বনাম কংগ্রেসের মধ্যে। বিজেপির বিজুলা কালিটা মেধি ও কংগ্রেসের মীরা বরঠাকুর গোস্বামীর মধ্যে মূল লড়াই হবে ৭ মে।
বিজুলা দীর্ঘদিন ধরে বিজেপির সঙ্গে যুক্ত। ছাত্রীবস্থায় তিনি ছিলেন মহিলা মোর্চার সভাপতি। গুয়াহাটির ডেপুটি মেয়রের ভূমিকাও তিনি পালন করেছেন। তাঁর বিপক্ষে আছেন মীরা গোস্বামী যিনি দীর্ঘদিন বিজেপিতে ছিলেন। ২০১৮ সালে পার্টি বিরোধী কার্যকলাপের জন্য তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। সিএএ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম মুখ হিসেবে উঠে এসেছেন মীরাদেবী। তাঁর কথায় বিজেপি যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াতে চাইছে, তার বিরুদ্ধে এবার প্রতিবাদ করবে গুয়াহাটির মানুষ।
লোকসভা নির্বাচনের ইতিহাসে ফিরে গেলে দেখা যাবে ১৯৫২ এবং ১৯৫৬ সালের লোকসভা নির্বাচন দুটিতে যথাক্রমে রোহিনী কুমার চৌধুরী এবং দেবেন্দ্রনাথ শর্মা জয়লাভ করেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে। ১৯৫৭ এবং ১৯৬২ সালে প্রজা সমাজতান্ত্রিক দলের প্রার্থী হেম বড়ুয়া পরপর দু’বার সাংসদ নির্বাচিত হন। গুয়াহাটি কেন্দ্র থেকে ১৯৬৭ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি জয়ী হয়। সিপিআই-এর পক্ষ থেকে ধিরেশ্বর কলিতা এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হন। ১৯৭১ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দীনেশ গোস্বামী গুয়াহাটি কেন্দ্রের সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৭৭ সালে কংগ্রেস বিরোধিতার হাওয়ায় এই কেন্দ্র থেকে জনতা দলের প্রার্থী রেনুকা দেবী জয়যুক্ত হন। ১৯৮৫ সালে দেখা যায় এই কেন্দ্রে নির্দল প্রার্থী হিসেবে দীনেশ গোস্বামী জয়ী হন৷ এর পরবর্তী লোকসভার নির্বাচন অর্থাৎ, ১৯৮৯ সালে অসমে নির্বাচন হয়নি। ১৯৯১-এর লোকসভায় ফের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে কিরিপ চালিহা সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে অসম গণ পরিষদের প্রবীর চন্দ্র শর্মা জয়ী হন এই কেন্দ্র থেকে। ১৯৯৮-এর লোকসভা নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেসের প্রার্থী ভুবনেশ্বর কালিটা নিকটতম প্রার্থীকে ১ লক্ষ ২৮ হাজার ভোটে পরাজিত করেন।
১৯৯৯ সালে নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টি প্রথমবারের জন্য এই কেন্দ্রটিতে জয়যুক্ত হয়। বিজেপির প্রার্থী বিজয়া চক্রবর্তী নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস প্রার্থীকে পরাজিত করেন ৭৫ হাজারের বেশি ভোটে। ২০০৪ সালে এই কেন্দ্রটিতে ফের একবার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে কিরিপ চালিহা জয়ী হন। ২০০৯ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে এই কেন্দ্র থেকে বিজেপি প্রার্থী বিজয়া চক্রবর্তী জয়ী হন। ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনে তিনি মাত্র ১১,৮৫৫ ভোটে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করেন, কিন্তু ২০১৪ সালে ৩ লক্ষ ১৫ হাজারেরও বেশি ভোটে জয়ী হন। ২০১৪ লোকসভায় ৭৮.৬ শতাংশ মানুষ এই কেন্দ্রে ভোটদানে অংশগ্রহণ করেছিল। অন্যদিকে সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রটি থেকে রানী ওজা বিজেপির পক্ষ থেকে জয়ী হন। তার জয়ের ব্যবধান ছিল ৩ লক্ষ ৪৫ হাজারের বেশি ভোট। ২০১৯ সালের লোকসভায় গুয়াহাটি কেন্দ্রটিতে ৯১.৯ শতাংশ মানুষ ভোটদানে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
এবার এক নজরে দেখে নেওয়া যাক গুয়াহাটি লোকসভা কেন্দ্রের অধীনস্থ বিধানসভা কেন্দ্রগুলির ২০২১ সালের ফলাফল। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ৩৩.৬ শতাংশ ভোট নিয়ে মোট সাতটি আসন পেয়েছিল, অন্যদিকে জাতীয় কংগ্রেস ২৯টি আসন পেয়েছিল ৩০ শতাংশ ভোটের শেয়ার ধরে রেখে। ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ১৬ টি আসন পায়, তাদের ভোটের শেয়ার ছিল ৯.৪ শতাংশ। ২০২১ সালের বিধানসভায় দুধনাই কেন্দ্রটি থেকে জাতীয় কংগ্রেসের প্রার্থী যাদব স্বর্গীয়ারী জয়ী হন। এছাড়া বোকো ও ছায়াগাঁও কেন্দ্র দুটিতেও জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে যথাক্রমে নন্দিতা দাস ও রেকিবউদ্দিন আহমেদ জয়ী হয়েছিলেন। এর মধ্যে দুধনাই এবং বোকো এই কেন্দ্র দুটি যথাক্রমে এসটি ও এসসিদের জন্য সংরক্ষিত। পলাশবাড়ি, জালুকবাড়ি, দিসপুর, গুয়াহাটি পূর্ব ও হাজো কেন্দ্রতে ভারতীয় জনতা পার্টির প্রার্থীরা জয়যুক্ত হন। পলাশবাড়ি, দিসপুর, গুয়াহাটি পূর্ব, হাজো কেন্দ্র চারটিতে যথাক্রমে ভারতীয় জনতা পার্টির পক্ষ থেকে হেমাঙ্গা ঠাকুরিয়া, অতুল বোরা সিনিয়র, সিদ্ধার্থ ভট্টাচার্য ও সুমন হরিপ্রিয়া জয়ী হন। জালুকবাড়ি বিধানসভা কেন্দ্রটি থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হয়ে হেমন্ত বিশ্বশর্মা অসমের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। অন্যদিকে গুয়াহাটি পশ্চিম কেন্দ্রটিতে অসম গণ পরিষদের রবীন্দ্রনারায়ণ কলিতা জয়যুক্ত হন। বারক্ষেত্রী বিধানসভা আসনটিতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দিগন্ত বর্মন জয়ী হন সর্বশেষ বিধানসভা নির্বাচনে।